প্রথম ঘড়া থেকে খুব সঙ্কোচের সঙ্গে একখানা মোহর তুলে দেখলেন তিনি। খাঁটি জিনিস।
“দ্যাখো, ভাল করে ফেলে ছড়িয়ে ঘেঁটে দ্যাখো। নইলে মজাটা কীসের? এসব তো ঘেঁটেই আনন্দ!”
তা ঘাঁটলেন বিপিন। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারা সকাল সোনাদানা হিরে-জহরত নাড়াচাড়া করে মনটা যেন স্বর্গীয় আনন্দে ভরে উঠল। ভজনবাবু তাই দেখে খুব হাসতে লাগলেন।
৬. গোবিন্দ ছোঁড়া যে লোক সুবিধের নয়
গোবিন্দ ছোঁড়া যে লোক সুবিধের নয় তা কি আর পীতাম্বর জানে না! কিন্তু ছোঁড়াটার ওপর বড্ড মায়া পড়ে গেছে পীতাম্বরের। চারদিকে কত গবেট মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, ফুর্তি করছে, তারা কি কেউ কখনও পীতাম্বরের গন্ধ পায়? না শব্দ পায়? না দেখা পায়? কারও গেরাহ্যিই নেই পীতাম্বরকে। তা এতকালের মধ্যে ওই গোবিন্দ ছোঁড়াই যাহোক একটু দাম তো দিল তার। মায়াটা সেইজন্যই। আর মুশকিলও সেইখানেই, কারণ, গোবিন্দর নানা অপকর্মে তাকে সাহায্য করতে হচ্ছে।
ভজনবুড়ো যখন মাঝরাতে চালাকি করে বিপিনকে নিয়ে পালাল তখন দিগভ্রান্ত গোবিন্দ আর গোপাল হাটখোলার দিকে। ছুটে গিয়েছিল। আর একটু হলেই বিপদ বাধাত। কারণ, নবীন মুদির জ্ঞান ফিরে এসেছে মাঝরাতে। তার চেঁচামেচিতে লোকে এসে দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করেছে এবং বৃত্তান্ত শোনার পর হাটখোলার লোকেরা এ-দু’জনকে ডাণ্ডা হাতে খুঁজে বেড়াচ্ছে চারদিকে।
গোঁয়ারগোবিন্দের মতোই গোপাল আর গোবিন্দ যখন হাটখোলার দিকে যাচ্ছিল তখন শীতলাবাড়ির মোড়ে গোবিন্দ ফট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “কে আমাকে ডাকছে বলো তো?”
“কে ডাকবে?”
“কেউ যেন ওদিকে যেতে বারণ করছে।”
“তোর মাথা! আজ কি তোকে ভূতে পেল?”
“ভূতই হবে। কিন্তু সে উপকারী ভূত। না গোপালদা, ওদিকে যাওয়া ঠিক হবে না।”
“কিন্তু ভজনবুড়ো যে পালিয়েছে, তার কী হবে? সাত ঘড়া মোহর, সাত কলসি হিরে।”
“আমার মন বলছে, ভজনবাবু এদিকে যায়নি।”
“মন বলে কি আমারও কিছু নেই রে? সেও কি কথা কয়?”
“শোনো গোপালদা, ফিরে গিয়ে চলো একটু চুপ করে বসি, কেউ আমাকে যেন কিছু বলতে চাইছে।”
গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “শেষে তুইও সিদ্ধাই হলি!”
গোবিন্দ যে তার কথা শুনতে পাচ্ছে এবং সেইমতো চলছে এতে পীতাম্বর খুব খুশি। পরিশ্রম সার্থক।
দু’জনে ফিরে এসে ফের খড়ের গাদির মধ্যে সেঁধিয়ে বসার পর পীতাম্বর চারপাশটা দেখে এল। ভজনবুড়ো বিপিনকে নিয়ে মধুবনির জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তাও পীতাম্বর জানে। এমনকী সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি মণিমানিক সে দেখেও এসেছে। হায় রে! বেঁচে থাকতে ওসবের সন্ধান পেলে কত ভাল হত!
সে না পাক, এখন গোবিন্দ পেলেও তার দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে। কিন্তু মুশকিল হল ভজনবুড়ো বিপিনকে সব সুলুকসন্ধান দিয়ে ফেলেছে। তাদের কাছ থেকে সব কেড়েকুড়ে নিতে পারবে কি দুধের বাছা গোবিন্দ? বিপিন কৃপণ লোক, কৃপণেরা ধনসম্পত্তি বাঁচাতে জান লড়িয়ে দেয়। তার ওপর ভজনবুড়ো আছে। যেমন ধূর্ত তেমনই পাষণ্ড, তেমনই গুণ্ডা। গোবিন্দ আর গোপাল তার কাছে দুধের শিশু। পীতাম্বর ভাবিত হয়ে পড়ল।
.
প্রতিভাবানের লক্ষণ হল তারা কোনও ঘটনাতেই ঘাবড়ে যায় না বা বিভ্রান্ত হয় না। মূল ঘটনা থেকে তারা কখনও মনঃসংযোগও হারায় না। কী ঘটতে পারে বা কী ঘটতে যাচ্ছে সেই সম্পর্কে তাদের দূরদৃষ্টি থাকে। লোকচরিত্র অনুধাবনেও তারা অতিশয় দক্ষ। এতসব গুণ আছে বলেই না আজ দশটা গাঁয়ের দুষ্টু লোকেরা চিতেনকে দেখলে সেলাম ঠোকে।
তবে হ্যাঁ, ভজনবুড়োর মতো ধূর্ত লোককে বিশ্বাস কী? চিতেন যদি ডালে ডালে চলে তো ভজনবাবু চলেন পাতায়-পাতায়। ধূতামিতে ভজনবাবু তাকে টেক্কা দিতে পারেন বলে একটা ভয় ছিলই চিতেনের। তাই রাত তিনটের সময় যখন সদর দরজাটা টুক করে খুলে একটু ফাঁক হল, তখনই চিতেন বুঝে গেল, এবার খেল শুরু হচ্ছে।
কিন্তু চালটা ভজনবাবু দিলেন বড়ই সোজা। ভজনবাবুকে খুঁজে না পেয়ে বিপিনবাবু যখন কান্না জুড়লেন এবং লোজন চারদিকে ভজনবাবুকে খুঁজতে ছুটল তখনও চিতেন অনুমান করল, ভজনবাবু ঘরেই আছেন। কারণ পেছনের দরজায় চিতেন তালা লাগিয়ে রেখেছে। ভজনবাবু তো মশামাছি নন যে জানলার ফাঁক দিয়ে উড়ে যাবেন। তাঁকে এই সদর দিয়েই বেরোতে হবে।
প্রতিভাবানদের আরও গুণ হল, তারা যখন দৌড়ায় তখন পায়ের শব্দ হয় না, তারা সহজে হাঁফিয়ে যায় না, শিকারের দিকে তাদের তীক্ষ্ণ নজর থাকে, তারা হোঁচট খেয়ে পড়ে না, বেড়া বা ছোটখাটো দেওয়াল অনায়াসে ডিঙোতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিভাবানেরা গা-ঢাকা দিতেও ওস্তাদ। এসব গুণের জন্যই চিতেন ভজনবাবু আর বিপিনদাদার পিছু নিয়ে মধুবনির জঙ্গলে পৌঁছে গেল। এটুকু আসতেই বিপিনদাদার দম বেরিয়ে গেল বটে, কিন্তু চিতেনের গাও গরম হল না।
জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার থাকায় আর গাছপালার বাড়বাড়ন্তর ফলে চিতেনের ভারী সুবিধে হয়ে গেল। অন্ধকারে প্রতিভাবানরা ভালই দেখতে পায়, চিতেনও দিব্যি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। পিছু নিতে তার কোনও অসুবিধে হল না।
ভজনবাবু যেখানে বিপিনবাবুকে এনে হাজির করলেন সে জায়গাটা মোটেই সুবিধের মনে হল না চিতেনের। ভাঙা বাড়ি, গাছপালা, গহিন বনের নির্জনতা থাকা সত্ত্বেও চিতেনের মনে হচ্ছিল, এখানে আরও একটা কোনও ব্যাপার আছে।