বিপিনবাবু লাঠিটা ধরলেন। কিন্তু ভজনবাবু যত স্বচ্ছন্দে এগোচ্ছেন, বিপিনবাবু লাঠি ধরে থেকেও তা পারছেন না। দু’বার লতাপাতায় পা জড়িয়ে পড়ে গেলেন। বড় বড় গাছের সঙ্গে দুমদাম ধাক্কা খেতে লাগলেন বারবার। কপাল কেটে রক্ত পড়তে লাগল, হাঁটুর ছাল উঠে জ্বালা করছে। বিপিনবাবু তবু অন্ধের মতো লাঠিটা ধরে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল, ভজনবাবু বুড়ো মানুষ তো ননই, আদতে মনিষ্যিই নন। এই বয়সে কারও এত শক্তি আর গতি থাকতে পারে?
কতবার পড়লেন, আরও কতবার গাছে ধাক্কা খেলেন তার আর হিসেব রইল না বিপিনবাবুর। কতক্ষণ এবং কতদূর হাঁটলেন সেটাও গুলিয়ে গেল। শেষ অবধি যখন এই শীতেও শরীরে ঘাম দিল আর হাত-পা একেবারে অসাড় হয়ে এল তখন হঠাৎ ভজনবাবু থামলেন। বললেন, “এই দ্যাখো, এই আমার ডেরা।”
বিপিনবাবু চোখ মেলে প্রথমটায় শুধু অন্ধকার দেখলেন। খানিকক্ষণ চেয়ে থাকার পর ধীরে-ধীরে আবছাভাবে দেখতে পেলেন, সামনে অনেক গাছ, ঝোঁপ আর লতাপাতার জড়াজড়ির মধ্যে যেন ভাঙাচোরা একটা বাড়ির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তোর হয়েছে অনেকক্ষণ, এখন আকাশে বেশ আলো ফুটেছে, কিন্তু এ-জায়গাটা এখনও সন্ধেবেলার মতো অন্ধকার।
ভজনবাবু খুব দয়ালু গলায় বললেন, “ওই তোমার বাঁ দিকে ঘাটের সিঁড়ি। পুকুরের জলে হাত-মুখ ধুয়ে নাওগে।”
বিপিনবাবু প্রায় ছুটে গিয়ে ঘাটে নেমে প্রথমটায় আঁজলা করে জল তুলে আকণ্ঠ পিপাসা মেটালেন। তারপর চোখেমুখে ঘাড়ে
জল দিয়ে নিজেকে একটু মনিষ্যি বলে মনে হল। যখন উঠে আসছেন তখন বাঁ দিকে একটা অদ্ভুত গাছ নজরে পড়ল তাঁর। বিশাল উঁচু সরল একটা গাছ, ডালপালা নেই। কিন্তু মগডাল থেকে গোড়া অবধি বড়-বড় পাতায় ঢাকা। এরকম গাছ তিনি জন্মে দ্যাখেননি।
জায়গাটা কেমন যেন ছমছমে, দিনের বেলাতেও কেমন যেন ভুতুড়ে ভাব।
রামভজনবাবু তাঁর বাঁদুরে টুপিটা গতকাল থেকে একবারও খোলননি। টুপির গোল ফোকর দিয়ে জুলজুলে চোখে বিপিনবাবুকে একটু দেখে নিয়ে বললেন, “কেমন বুঝছ হে?”
“আজ্ঞে, হাত-পায়ে একটু অসাড় ভাব আছে, বুকটা ধড়ফড় করছে, মাথাটা ঝিমঝিম, মাজায় টনটন, কানে একটু ঝিঝি। হাঁটু দুটো ভেঙে আসতে চাইছে। সর্বাঙ্গে এক লক্ষ ফোড়ার ব্যথা। তা হোক, তবু ভালই লাগছে।”
“বাঃ বাঃ; এই তো চাই। কষ্ট না করলে কি কেষ্ট পাওয়া যায় হে! এসো, এবার ডেরায় ঢোকা যাক।”
চারদিকে এত আগাছা আর জঙ্গল হয়ে আছে যে, এর ভেতরে কী করে ঢাকা যাবে তা বুঝতে পারলেন না বিপিনবাবু। কিন্তু রামভজনবাবু ওই বুকসমান জঙ্গলের ফাঁক দিয়েই একটা সরু পথ ধরে ঢুকতে লাগলেন। বিপিনবাবু সভয়ে বললেন, “সাপখোপ নেই তো ভজনবাবু?”
“তা মেলাই আছে। তবে শীতকালে তারা ঘুমোয়।”
বিপিনবাবু দেখতে পেলেন, সামনে বাড়ি নয়, বাড়ির একটা ধ্বংসস্তৃপই পড়ে আছে। শ্যাওলায় কালো হয়ে আছে খাড়া দেওয়ালগুলো। ভজনবাবু ধ্বংসস্তৃপটা পাশ কাটিয়ে বাঁ দিক দিয়ে বাড়ির পেছন দিকটায় উঠলেন।
বাড়িটা একসময়ে বেশ বড়সড়ই ছিল, বোঝা যায়। বিপিনবাবু দেখলেন, পেছন দিকে গোটাদুই ঘর এখনও কোনওমতে খাড়া আছে। জরাজীর্ণ দরজা-জানলাগুলি এখনও খসে পড়েনি।
বিপিনবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, “এ কী! দরজায় তালা দিয়ে রাখেননি?”
ভজনবাবু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে একটু হাসলেন, “তালা দেব কার ভয়ে? এখানে কে আসবে?”
“সাবধানের মার নেই কি না?”
ঘরে ঢুকে বিপিনবাবু দেখলেন, একধারে একখানা নড়বড়ে চৌকিতে একখানা শতরঞ্চি পাতা। একটা বালিশ, আর কম্বল।
ভজনবাবু বললেন, “এই তোমার বিছানা।”
“আমার বিছানা? আর আপনি!”
“আমার অন্য ব্যবস্থা আছে। এবার এসো, আসল জিনিস। দেখবে।”
“যে আজ্ঞে।”
ভজনবাবু পাশের ঘরটাতে ঢুকে মেঝেতে একখানা লোহার গোল ঢাকনা টেনে তুললেন। তলায় গর্ত।
গর্তের ভেতরে লোহার সিঁড়ি নেমে গেছে। ভজনবাবু নামতে-নামতে বললেন, “এসো হে।”
বিগলিত হয়ে বিপিনবাবু বললেন, “আসব? সত্যিই আসব? আমার একটু লজ্জা-লজ্জা করছে।”
“আহা, লজ্জার কী? নিজের জিনিস মনে করে সব বুঝে নাও। তারপর আমার ছুটি।”
“সত্যি বলছেন তো ভজনবাবু? ছলনা নয় তো!”
“ওরে বাবা, না। বুক চিতিয়ে চলে এসো।” বিপিনবাবু ভজনবাবুর পিছু পিছু সরু লোহার সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নামলেন। নীচের ঘরটা খুব একটা নীচে নয়। বড় জোর পাঁচ-সাত হাত হবে। বিপিনবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, একটা মৃদু আলোর আভায় ঘরটা বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। আলোটা কোথা থেকে আসছে তা দেখতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। ঘরের মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড কালো সাপ ফণা তুলে আছে, তারই মাথা থেকে একটা আলো বেরোচ্ছে।
ভজনবাবু বললেন, “ভয়ের কিছু নেই। সাপটা পাথরের। আর আলোটা দেখতে পাচ্ছ ওটা সাপের মাথার মণি। আসল সাপের মাথা থেকে এনে পাথরের সাপের মাথায় বসানো হয়েছে।”
বিপিনবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “সে মণির তো লাখো-লাখো টাকা দাম!”
“কোটি-কোটি টাকা।”
.
ঘরের একধারে পর পর সাতটা ঘড়া, অন্য ধারে পর পর সাতটা কলসি সাজানো।
ভজনবাবু বললেন, “হাঁ করে দেখছ কী! যাও, গিয়ে ভাল করে মোহরগুলো পরখ করো! এই নাও কষ্টিপাথর। ঘষেও দেখতে পারো।”
বিপিনবাবুর হাত-পা কাঁপছিল। স্বপ্ন দেখছেন না তো! নিজের হাতে একটা রামচিমটি কেটে নিজেই ‘উঃ করে উঠলেন। না, স্বপ্ন নয় তো? ঘটনাটা যে ঘটছে!