কেউ জবাব দিল না। বিপিনবাবু বিছানা ছেড়ে নেমে এসে অন্ধকারেই চারদিক খুঁজতে লাগলেন। চেয়ার, টেবিল এবং খাটের বাজুতে বারকয়েক ধাক্কা খাওয়ার পর হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল, সদর দরজাটা যেন সামান্য ফাঁক হয়ে আছে!
কাছে গিয়ে দেখলেন, সত্যিই খিল খোলা। তবে কি রামভজনবাবু রাগ করে চলে গেলেন? কেন গেলেন? লুচিতে ঠিকমতো গাওয়া ঘিয়ের ময়ান দেওয়া হয়নি? আলুর দমে কি গরমমশলা ছিল না? বেগুন কি ডুবো তেলে ভাজা হয়নি? না কি ঘন দুধের ওপর পুরু সর ছিল না? কোন ত্রুটিটা ধরে তিনি এমনভাবে বিপিনবাবুকে ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন?
বিপিনবাবু খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “রামভজনবাবু! এ আপনি কী করলেন রামভজনবাবু। আমাকে যে পথে বসিয়ে দিয়ে গেলেন! সামান্য ত্রুটির জন্য সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি হিরে-জহরত থেকে অধমকে বঞ্চিত করলেন!”
কান্নার শব্দে লোকজন সব জেগে উঠে শোরগোল তুলল।
“পালিয়েছে! পালিয়েছে! ছেলেধরা পালিয়েছে!” কেউ বলল, “ওরে দ্যাখ, জিনিসপত্তর কী কী নিয়ে গেল?”
গোপাল আর গোবিন্দ তেড়েফুঁড়ে উঠে বলল, “আমরা যে পদসেবা করব বলে লাইন দিয়ে বসে আছি..”
তুমুল হইহট্টগোল বেধে গেল। তারপর লোকজন টর্চ আর লণ্ঠন নিয়ে চারদিকে খুঁজতে ছুটল। তিন মাসি পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল। সেই চেঁচানোর কোনও মাথামুণ্ডু নেই। যেমন কাশীবাসী মাসি বললেন, “কেমন, আগেই বলেছিলাম কি না।”
হাসিরাশি মাসি বললেন, “আমিও ঠিক টের পেয়েছিলুম গো দিদি!”
হাসিখুশি মাসি বললেন, “আমি তো তখন থেকে পইপই করে বলছি?”
ঠিক এই সময়ে খাটের তলা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে রামভজনবাবু বেরিয়ে এসে বিপিনবাবুকে বললেন, “ওহে, আর দেরি করা ঠিক হবে না। এই সুযোগ!”
বিপিন কান্না ভুলে হাঁ করে চেয়ে থেকে অন্ধকারেই বললেন, “রামভজনবাবু নাকি! স্বপ্ন দেখছি না তো?”
“না হে আহাম্মক। এই চালাকিটা না করলে বিপদ ছিল। আর দেরি নয়, তাড়াতাড়ি চলো।”
বিপিন লাফিয়ে উঠে পড়ে বললেন, “যে আজ্ঞে।”
সদর খুলে দুজনে বেরিয়ে এলেন। ভজনবাবু বললেন, “পথঘাট ধরে যাওয়া ঠিক হবে না। আঘাটা আর খানাখন্দ ধরে চলো হে।”
বিপিনবাবুর কোনও আপত্তি হল না। খানিক হেঁটে, খানিক দৌড়ে রামভজনবাবুর গতিবেগের সঙ্গে তাল রাখতে রাখতে বিপিনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “তা জায়গাটা কত দূর হবে মশাই!”
“দূর কীসের? দুটো গাঁ পেরোলেই মধুবনির জঙ্গল। তারপর আর পায় কে? চলো, চলো, রাত পোয়াবার আগেই জঙ্গলে ঢুকে পড়তে হবে।”
“সে আর বলতে! তা রামভজনবাবু, অভয় দিলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি।”
“কী কথা?”
“মোহর নিয্যস সাত ঘড়াই তো!”
“একেবারে নিয্যস।”
“আর সাত কলসি হিরে-জহরত, তাই না?”
“ঠিকই শুনেছ।”
“মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছে ভুল শুনিনি তো?”
“কিছুমাত্র ভুল শোনননি। কিন্তু অমন থপথপ করে হাঁটলে তো হবে না। দৌড়ও, জোরে দৌড়ও!”
“যে আজ্ঞে।“ বলে যথাসাধ্য দৌড়তে-দৌড়তে বিপিন হাপসে যেতে লাগলেন। হাঁফাতে-হাঁফাতে একসময়ে আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠলেন, “ভজনবাবু! আপনি রক্তমাংসের মানুষ তো!”
“তা নয় তো কী?”
“ঠিক তো ভজনবাবু? আমার যে মনে হচ্ছে আপনি মাটির ওপর দিয়ে হাঁটছেন না, কেমন যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছেন!”
“তুমিও উড়বার চেষ্টা করো হে বিপিন। আমার সঙ্গে তাল দিয়ে হাঁটতে না পারলে যে সেখানে পৌঁছতেই পারবে না।”
“বলেন কী মশাই, সেখানে না পৌঁছে ছাড়ার পাত্রই আমি নই। এই যে দেখুন, দৌড়ের জোর বাড়িয়ে দিলুম।”
“বাঃ বাঃ, বেশ!”
“আপনার বয়স যেন কত হল ভজনবাবু?”
“একশো ত্রিশ। তোমার চারগুণেরও বেশি।”
“কেমন যেন পেত্যয় হয় না। আচ্ছা ভজনবাবু!”
“বলে ফ্যালো?”
“আপনি কি একটু একটু করে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছেন? আপনার আর আমার মধ্যে তফাতটা যেন বেড়ে যাচ্ছে!”
“বাপু হে, তফাত তো বাড়বেই। তোমার যে মোটে গা নেই নেই দেখছি, সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি হিরে-জহরতের কথা একটু ভেবে নাও, গা গরম হয়ে যাবে। তখন দেখবে হরিণের মতো ছুটছ।”
“যে আজ্ঞে।”
ছুটতে ছুটতে বিপিনবাবু চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। তেষ্টায় বুক যেটে যেতে লাগল। পা আর চলে না। ভজনবাবু যেন ক্রমে ক্রমে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছেন। তবু বিপিনবাবু হাল ছাড়লেন না। সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি মণিমাণিক্যের কথা ভেবেই এখনও শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলেছেন।
তবে কষ্টের শেষও হল একসময়ে। একটা মস্ত জঙ্গলের ভেতর ভজনবাবুর পিছু পিছু ঢুকে পড়লেন বিপিনবাবু। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ায় মুখে কথা ফুটল না।
ভজনবাবুই দয়া করে বললেন, “এসে গেছি হে। আর কিছু দূর এগোলেই আমার আস্তানা। এখন আর ছুটতে হবে না।”
বিপিনবাবুর চোখ কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল।
পুবদিকে ভোরের আলো ফুটি-ফুটি করছে। অন্ধকার পাতলা হয়ে এসেছে। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে এখনও অমাবস্যার অন্ধকার। তার ওপর জঙ্গল এত ঘন যে, এগনো ভারী কষ্টকর। বিপিনবাবু এই অন্ধকারে ভজনবাবুকে একেবারেই দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ডাকাডাকি করা সম্ভব হচ্ছে না। গলা শুকিয়ে স্বরভঙ্গ হয়ে আছে।
হঠাৎ সামনে থেকে ভজনবাবু লাঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা শক্ত করে ধরে থাকো হে বিপিন, নইলে এ-জঙ্গলে একবার হারিয়ে গেলে ঘুরে-ঘুরে মরতে হবে।”