চিতেন নাক সিঁটকে বলল, “অমন লোকের কাজ করা মানে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ। আপনারা বরং গিয়ে কত্তাবাবুর কাজে ইস্তফা দিয়ে সন্নিসি হয়ে হিমালয়ে চলে যান।”
গোবিন্দ দুঃখের সঙ্গে বলল, “আমিও সেই কথাই গোপালদাকে বলি। রেটটা কম হয়ে যাচ্ছে বড়।”
চিতেন বলেন, “খুবই কম। রামভজনবাবুর বাজারদর এখন আকাশছোঁয়া। হবে নাই বা কেন? সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি হিরেমুক্তোর মালিক বলে কথা, তাঁর মতো লোককে ধরবেন মাত্র একান্ন টাকা মজুরিতে? আপনাদের কত্তাবাবু যে দেখছি বিপিনবাবুর চেয়েও কঞ্জুষ।”
গোপাল আর গোবিন্দর চোখ হঠাৎ গোল হয়ে ভেতরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে চেয়ে থেকে গোপাল ফিসফিস করে বলল, “কী বললেন ভাই? ঠিক শুনেছি তো?”
“ঠিক শুনেছেন।”
“সাত ঘড়া কী যেন।”
“মোহর।”
“আর সাত কলসি কী যেন?”
“হিরে আর মুক্তো। অ্যাই বড়-বড় কাশীর পেয়ারার সাইজের হিরে আর সবেদার সাইজের বড় বড় মুক্তো। এখনও ভেবে দেখুন কত্তাবাবুর কাজ করবেন কি না।”
গোপাল বলল, “দুর, দুর। আমি এই এখনই এই মুহূর্তেই এখানে দাঁড়িয়ে কত্তাবাবুর কাজে ইস্তফা দিলুম। তুইও দিবি নাকি গোবিন্দ?”
“এই যে দিলুম।”
চিতেন খুশি হয়ে বলল, “বাঃ, বাঃ, চমৎকার। তা এই কত্তাবাবুটি কে?”
“বিদ্যাধরপুরের পাঁচুগোপাল। অতি বজ্জাত লোক।”
চিতেন বলল, “অ, তাই বলুন। রামভজনবাবু তাকেই প্রথমে পছন্দ করেছিলেন বটে। কিন্তু বিপিনবাবুকে দেখে তাঁর মত পালটেছে। এখন সব বিষয়সম্পত্তি বিপিনবাবুকেই দিয়ে যাবেন ঠিক করে ফেলেছেন।”
গোপাল ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, “তা রামভজনবাবু এখন কোথায়?”
“তিনি এখন লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন, আর বিপিনদাদা তাঁর পা টিপছেন।”
গোপাল শশব্যস্তে বলল, “তা আমরা একটু তাঁর পদসেবা করার সুযোগ পাই না? দিন না একটু ব্যবস্থা করে। না হয় আরও কুড়িটা টাকা দিচ্ছি।”
চিতেন বলে, “খবরদার, ও-কাজ করবে না। ভজনবাবুর পা এখন বিপিনবাবুর দখলে। প্রাণ গেলেও ওই পা তিনি কারও হাতে ছাড়বেন না।”
গোপাল অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “তা বললে কি হয় কখনও? ভজনবাবুর পায়ের ওপর কি আমাদেরও দাবি নেই? একজন দখল করে বসে থাকলেই হবে?”
গোবিন্দ বলল, “ঠিক কথা। ভজনবাবুর সেবা করার অধিকার সকলেরই আছে।”
চিতেন একটু হেসে বলল, “সেবার কথা আর বলবেন না মশাই। সেবা নিতে নিতে ভজনবাবুর এখন অরুচি। বললে বিশ্বাস করবেন না, তিনি তো সোনাদানা আগলে গহিন জঙ্গলের মধ্যে বাস করেন। জনমনিষি নেই। তা সেখানেও কী হয় জানেন? দু বেলা দুটো কেঁদো বাঘ এসে রোজ তাঁর পিঠ চুলকে দেয়। ঘুমনোর সময় দুটো গোখরা সাপ এসে তাঁর দু কানে লেজ ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুম পাড়ায়। এই শীতকালে রাতের দিকে যখন হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়ে তখন হলধর আর জলধর নামে দুটো ভালুক এসে দু’ধার দিয়ে ভজনবাবুকে জড়িয়ে ধরে ওম দেয়। গদাধর নামে একটা কেঁদো হনুমান বোজ তাঁর জন্য গাছ থেকে ফলটল পেড়ে আনে। কামধেনু নামের একটা গোরু এসে দুবেলা দু ঘটি করে দুধ দিয়ে যায়…”
গোপাল আর গোবিন্দর চোখ ক্রমে ছানাবড়া হচ্ছিল। গোপাল বলল, “বলেন কী মশাই!”
চিতেন একটু ফিচকে হেসে বলে, “ঠিকই বলছি। যাঁর অত সোনাদানা আছে তাঁকে কে না খ্যাতির করে বলুন। তবে ভজনবাবুর তো দিন ফুরিয়ে এল। শুনছি তিনি বিপিনবাবুকে সব দিয়েথুয়ে সমিসি হয়ে হিমালয়ে চলে যাবেন।”
গোপাল শশব্যস্তে বলল, “আচ্ছা না-হয় ভজনবাবুর পা না-ই টিপলুম, বিপিনবাবুর পদসেবা করারও কি সুযোগ হবে না মশাই?”
চিতেন দুঃখের সঙ্গে বলে, “বিপিনদাদার তো দুটো বই ঠ্যাং নেই। তা সে দুটোর জন্যও মেলা উমেদার। আমার খাতায় ইতিমধ্যেই বিশ-পঁচিশজনের নাম উঠে গেছে। মাথাপিছু কুড়ি টাকা রেট।”
গোপাল গোবিন্দকে ধমকে উঠে বলল, “হাঁ করে দেখছিস কী? দে টাকাটা গেঁজে থেকে বের করে।”
গোবিন্দর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ট্যাঁকে খুঁজে চিতেন বলল,
“বিপিনদাদা আমাকে তাঁর ম্যানেজার করে যে কী ঝঞ্ঝাটেই। ফেলেছেন।”
গোপাল চোখ কপালে তুলে বলল, “আপনিই তাঁর ম্যানেজার? প্রাতঃপেন্নাম হই।”
গোবিন্দ হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “কী সৌভাগ্য! এ যেন অমাবস্যায় চাঁদের উদয়। কী বলল গোপালদা?” “ঠিক বলেছিস। এ যেন কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।”
৫. নিজের ঢেকুরের শব্দে
নিজের ঢেকুরের শব্দে চমকে জেগে উঠে বিপিনবাবু বলে উঠলেন, “কে রে?” পরমুহূর্তেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে একা-একাই লজ্জা পেলেন। ঢেকুরের আর দোষ কী? কাল রাতে রামভজনবাবুর পাল্লায় পড়ে কয়েকখানা লুচি খেয়েছেন। কৃপণের পেটে গিয়ে লুচি যেন আজব দেশে এসেছে, এমন হাবভাব শুরু করে দিয়েছিল তখনই। প্রকাণ্ড ঢেকুরটা যেন লুচির বিদ্রূপ।
বিপিনবাবু উঠে বসে বিছানা হাতড়ে রামভজনের পা দু’খানা অন্ধকারে খুঁজতে লাগলেন। পা টিপতে টিপতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, সেজন্য লজ্জা হচ্ছিল। উনি কিছু মনে করলেন না তো?
কিন্তু পা দু’খানা বিছানার কোথাও খুঁজে পেলেন না বিপিনবাবু। আশ্চর্য! রামভজনবাবুর দু-দুখানা পা যাবে কোথায়? তেলের অপচয় হয় এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বলে বিপিনবাবু ঘরে আলো জ্বেলে রাখেন না, তাঁর টর্চবাতিও নেই। ফলে অন্ধকারে হাতড়াতে-হাতড়াতে তিনি রামভজনবাবুর হাত, কোমর, পেট, বুক, এমনকী মাথা অবধি খুঁজে দেখলেন। এবং অতি আশ্চর্যের বিষয় যে, রামভজনবাবুর পা দু’খানার মতোই হাত দুখানাও গায়েব হয়েছে। এমনকী, পেট, বুক এবং মাথা অবধি লোপাট। এত জিনিস একসঙ্গে কী করে উধাও হতে পারে, তা তিনি ভেবে পেলেন না। তিনি খুব করুণ মিনতির সুরে বললেন, “রামভজনবাবু! রামভজনবাবু! আপনি কোথায়?”