“বলেন কী!”
পাশ থেকে একজন রোগাভোগা লোক বলল, “তলোয়ার নয়, তার হাতে রাম-দা। আর চার হাত কি বলছ, সে পাঁচ হাতের সিকি ইঞ্চি কম নয়। সন্ধের দিকে একটা গর্জন ছেড়েছিল তাতে আমার নারকোল গাছ থেকে দুটো নারকোল খসে পড়েছে।”
মাফলারে মুখ-ঢাকা একটা লোক চাপাগলায় বলল, “ফুঃ, তোমরা তাকে মানুষ ঠাওরালে নাকি? সে মোটেই মানুষ নয়, নির্যস অপদেবতা। আর সন্ধের মুখে তো আমার খুড়তুতো ভাই নন্দর সঙ্গে রথতলার মোড়ে তার দেখা। নন্দ ডাকাবুকো লোক, অত বড় চেহারার মানুষ দেখে ডাকাত বলে ধরতে গিয়েছিল। ধরলও জাপটে। লোকটা স্রেফ হাওয়া হয়ে গেল। দশ হাত পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলল, “কী রে, ধরবি? আয় ধর দেখি।’ তা ভয় পেয়ে নন্দ চোঁ-চা দৌড়।”
গোপাল নিরীহ গলায় বলল, “ এখন ছেলেধরাটা ঘরের মধ্যে কী করছে?”
বেঁটে লোকটা বলল, “কী আর করবে! বিপিনকে বস্তায় পুরে বাঁধাছাঁদা করছে বোধ হয়।”
লম্বা একটা লোক বলল, “আরে না, না, সে বৃত্তান্তই নয়। বিপিনকে কখন বশীকরণ করে ফেলেছে। সে এখন লোকটার পা টিপছে।”
গোপাল বলল, “তা আমরা একটু লোকটাকে দেখতে পাই না?”
“দেখে হবেটা কী? ও না দেখাই ভাল।”
গোপাল আর গোবিন্দ একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল। গোবিন্দ বলল, “কিন্তু তা হলে শুটকো বুড়োটা কোথায় গেল বলল
তো গোপালদা! যা বিবরণ শুনছি তাতে তো সে এই লোক বলে মনে হচ্ছে না!”
গোপাল তোধিক গলা চেপে বলল, “তুই বড় আহাম্মক। এতদিন এ-লাইনে আছিস। আর এটা জানিস না যে, গাঁয়ের লোকেরা সবসময়ে তিলকে তাল করে! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস কী?”
“তা বটে! কিন্তু তেনাকে চাক্ষুষ করারই বা উপায় কী বলো!”
“একটা কথা আছে, সবুরে মেওয়া ফলে। দামি কথা। মনে রাখিস।”
ওদিকে তিন মাসির মাঝখানে বসেও চিতেনের চোখ ঠিকই কাজ করে যাচ্ছিল। সে একজন প্রতিভাবান মানুষ, কাজেই তার চোখ আর পাঁচজনের মতো ম্যাস্তামারা চোখ নয়। সব সময়ে চারদিককার সবকিছুকে দেখছে, বিচার-বিশ্লেষণ করছে এবং কাজেও লাগাচ্ছে। চিতেন আবছা আলোতেও দুজন অচেনা লোককে ভিড়ের পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। পাজি লোকদের সে লহমায় চিনতে পারে। এ-দু’জন যে পাকা পাজি, তা বুঝে নিতে তার এক মুহূর্তও সময় লাগল না।
চিতেন টপ করে উঠে পড়ল। ধীরেসুস্থে হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে গিয়ে নিচুগলায় জিজ্ঞেস করল, “এ-গাঁয়ে নতুন বুঝি?”
লোক দুটো একটু অস্বস্তিতে পড়ে দুজনে একসঙ্গেই বলে, “হ্যাঁ।”
“তা আপনারা কারা?” একজন বলল, “আমি গোপাল, আর ও গোবিন্দ।”
“বাঃ, বেশ, বেশ। তা কাজটা কী?”
গোপাল একটু আমতা-আমতা করে বলল, “একজন লোককে খুঁজতে আসা। সে বিশেষ ভাল লোক নয়। শুনলাম সে বিপিনবাবুর বাড়িতে থানা গেড়েছে।”
“কেমন লোক বলুন তো?”
“চেহারার বুড়োমানুষ। বয়স ধরুন হেসেখেলে দেড়শো বছর।”
চিতেন খুব ভাবিত হয়ে বলল, “দেড়শো বছর! নাঃ মশাই, একটু কমসম হলেও না হয় ভেবে দেখা যেত। এত বয়সের লোক কোথায় পাব বলুন তো! সাপ্লাই নেই যে!”
গোপাল একটু থতমত খেয়ে বলে, “তা কিছু কমও হতে
পারে।”
চিতেন একটু হেসে বলল, “তাই বলুন! তা ধরুন একশো বিশ ত্রিশ বছর হলে চলবে?”
“খুব চলবে।”
“শুটকো চেহারা বললেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। খুব শুটকো।”
চিতেন একগাল হেসে বলল, “পেয়ে যাবেন।”
গোপাল উজ্জ্বল হয়ে বলল, “পাব মশাই? কোথায় পাব?”
“অত ভেঙে তো বলা যাবে না। তবে আমার হাতে একজন একশো ত্রিশ বছরের শুটকো চেহারার লোক আছে। কুড়িটা টাকা পেলে তাকে দেখিয়ে দিতে পারি। পছন্দ হলে আরও কিছু লাগবে।”
পটল বিরস মুখে বলে, “শুধু দেখতেই কুড়ি টাকা? দরটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না মশাই? তার ওপর যদি আসল লোক না হয়”
“আসল কি না জানি না মশাই, তবে তাঁর নাম রামভজন, তিনি একজন কৃপণ লোক খুঁজে বেড়াচ্ছেন।”
গোপাল চাপা গলায় গোবিন্দর কানে কানে বলল, “গেজেটা থেকে টাকাটা দিয়ে দে। পরে উসুল করে নিলেই হবে।”
গোবিন্দ বিরস মুখে তাই করল।
চিতেন টাকাটা ট্যাঁকে খুঁজে বলল, “উঠোনের ওই দিকটায় ওই যে চালাঘর দেখছেন ওখানে খড় গাদি করা আছে। ওর মধ্যে সেঁধিয়ে বসে থাকুন। একটু ঘুমিয়েও নিতে পারেন। প্রাতঃকাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে। যখন তিনি প্রাতঃকৃত্য করতে বেরোবেন তখন তাঁকে দু চোখ ভরে দেখে নেবেন।”
“সে কী মশাই! আমাদের যে আজ রাতেই তাকে নিয়ে কত্তাবাবুর কাছে হাজির হওয়ার কথা!”
“পাগল নাকি? এই যে গাঁয়ের লোকেরা জড়ো হয়েছে দেখছেন, এরা সব সারারাত পাহারা দেবে। একজন ছেলেধরা এসে গাঁয়ের একটা লোককে ধরে নিয়ে যাবে, এমন মজা ছাড়ে কেউ? তা কত্তাবাবুটি কে?”
“আছেন একজন।”
“তা কত্তাবাবুর সঙ্গে বন্দোবস্তটা কীরকম হল?”
গোবিন্দ ক্ষোভের সঙ্গে বলে বসল, “সে আর বলবেন না। মশাই, মোটে একান্ন টাকা করে। এই যে এত হয়রানি হুজ্জত করতে হচ্ছে একান্ন টাকায় পোষায়, বলুন তো নায্য কথা!”
চিতেন খুব অবাক হয়ে বলে, “একান্ন টাকা! মোটে একান্ন টাকায় এত বড় কাজ! এর যে হেসেখেলে বাজারদর দু থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এঃ হেঃ হেঃ, আপনাদের যে বড্ড ঠকানো হচ্ছে দেখছি!”
গোপাল গোবিন্দকে কনুইয়ের একটা খুঁত দিয়ে চুপ করিয়ে রেখে নিজে বলল, “তা মশাই, ভোরের আগে কিছু করা যায় না? কত্তাবাবু যে বসে আছেন। বড্ড মেজাজি মানুষ। রেগে গেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না কি না।”