কাশীবাসী মাসি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “বুড়োটাকে দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম, এ ছেলেধরা না হয়েই যায় না। ছেলেমানুষ বিপিনটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কাশীর গলিতে-গলিতে ভিক্ষে করাবে।”
হাসিরাশি মাসি বললেন, “সে তো তবু ভাল। কাশীতে ভিক্ষে করলে পুণ্যি হয়। লোকটার চোখ দ্যাখোনি! যেন ভাঁটার মতো ঘুরছে। বলে রাখছি, মিলিয়ে নিয়ে, এ-লোক হল ছদ্মবেশী কাঁপালিক। নরবলি দেওয়ার জন্য কচি বাচ্চা খুঁজতে বেরিয়েছে। তাই বিপিনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।”
হাসিখুশি মাসি বলে উঠলেন, “বালাই ষাট। ওকথা কি বলতে আছে? তবে বলেই যখন ফেললে ছোড়দি, তখন আমিও বলি, নরবলি দিয়েই কি ক্ষান্ত থাকবে ভেবেছ? তারপর বিপিনের আত্মাটাকে ভূত বানিয়ে দিন-রাত বেগার খাটাবে।”
প্রতিবেশী নরহরিবাবু বললেন, “তা অত ভাববার কী আছে? দিন না লোকটাকে আমাদের হাতে ছেড়ে। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দিই।”
কাশীবাসী মাসি আর্তনাদ করে উঠলেন, “ও বাবা! তার কি জো আছে? লোকটা যে বিপিনকে বশ করে ফেলেছে গো! দ্যাখোগে যাও, গুচ্ছের লুচি গিলে সে-লোক ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোচ্ছ, আর বিপিন তার পা টিপে দিচ্ছে। বলেই দিয়েছে, ভজনবাবুর যদি কোনও ক্ষতি হয়, তা হলে সে আত্মহত্যা করবে।”
এইবার একটু ফাঁক পেয়ে চিতেন বলে উঠল, “আহা, সব জিনিসেরই যেমন খারাপ দিক আছে, তেমনই একটা ভাল দিকও আছে।”
হাসিরাশি মাসি ধমকে উঠলেন, “ভাল দিক আবার কী রে হতভাগা? এর মধ্যে কোন ভালটা তুই দেখলি?”
চিতেন হেসে বলল, “আছে গো মাসি, আছে। সেটা ভেঙে বলা যাবে না। তবে লেগে গেলে সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হবে। বিপিনদাদা এক লম্ফে একেবারে মগডালে উঠে যাবেন।”
হাসিখুশি মাসি বললেন, “কেন, বিপিন কি হনুমান?”
চিতেন খুশি হয়ে বলল, “জব্বর কথাটা বলেছেন বটে মাসি। হনুমানই বটে! আমার অনুমান, এবার বিপিনদাদা হনুমানের মতো এক লাফে দুঃখের সমুদুর ডিঙিয়ে একেবারে সুখের স্বর্ণলঙ্কায় গিয়ে পড়বেন।”
ওদিকে বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরবাড়ির শোরগোল আর মড়াকান্না শুনে গোবিন্দ আর গোপাল একটু থতমত খেল।
গোপাল বলে, “কান্না কীসের? কেউ মরেছে নাকি?”
গোবিন্দ বলল, “তাই তো মনে হচ্ছে।”
হলধরকে তারা ছাড়েনি। হলধর চিঁ চিঁ করে বলল, “ওরে বাবা, আমি মরা-টরা যে একদম পছন্দ করি না। এই বার আমাকে ছেড়ে দাও বাবাসকল।”
গোবিন্দ একটু শঙ্কিত গলায় বলল, “ভজনবুড়োটাই মরেনি তো গোপালদা! তা হলেই তোত চিত্তির। একান্নটা টাকা জলে গেল!”
“আমারও একান্ন টাকা। রেটটা কত্তাবাবু কম দিচ্ছিলেন বলে বেশ রাগ হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, রেটটা কম হওয়াতে ক্ষতিটাও কমই হল।”
গোবিন্দ বলল, “সেটা আবার কীরকম হিসেব গো গোপালদা?”
“বুঝলি না?”
“বুঝিয়ে দিলে তো বুঝব!”
“ধর, ভজনবুড়োকে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কত্তাবাবু যদি পাঁচশো টাকা করে বখশিশ কবুল করতেন, তা হলে আজ ওই পাঁচশো টাকা করেই জলে যেত। তবে দেখতে হবে ভজনবুড়ো সত্যিই মরেছে কি না।”
গোবিন্দ হতাশ গলায় বলল, “সে ছাড়া আর কে মরবে? দেড়শোর কাছাকাছি বয়স, মরলে তারই মরার কথা।”
গোপাল বলল, “মানলুম। কিন্তু ভজনবুড়ো মরলে এরা কাঁদবে কেন বলতে পারিস? ভজনবুড়ো মরলে এদের কী? সে এদের কে? পরস্য পর বই তো নয়।”
“আহা পর মরলে কি লোকে কাঁদে না? সবাই তো আর আমাদের মতো পাষণ্ড নয়। তা এ লোকটার কী ব্যবস্থা করবে?”
“একটা রদ্দা মেরে ঝোপে ঢুকিয়ে দে।”
হলধর এই আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই গোবিন্দ তার মাথায় একখানা রঙ্গা বসিয়ে অজ্ঞান করে একটা ঝোঁপের পেছনে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “বোষ্টম হয়ে আর কত পাপ যে করব?”
গোপাল কানখাড়া করে কান্নার শব্দ শুনে বলল, “এ যা কান্না শুনছি, তাতে একজন মরেছে বলে মনে হয় না। দু-তিনজন মরেছে বলে মনে হচ্ছে। মেলা লোকের গলাও শুনতে পাচ্ছি।”
গোবিন্দ উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, “তা হলে কী হবে গোপালদা?”
“লোকজন যখন জড়ো হয়েছে তখন সুবিধের কথাই। চল, পেছন দিক দিয়ে গিয়ে ভেতরবাড়িতে ঢুকে ভিড়ে মিশে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝি।”
তো তাই হল। দুজনে গুটিগুটি বাড়ির পেছন দিক দিয়ে উঠোনে ঢুকে দেখল, পনেরো-বিশজন লোক এই শীতের রাতে উঠোনে জড়ো হয়েছে। বারান্দায় একখানা হারিকেন জ্বলছে, তার একটুখানি মাত্র আলো। তাতে উঠোনের কারওই মুখ বুঝবার উপায় নেই। দুজনে মুড়িসুড়ি দিয়ে একটু পেছনে চেপে দাঁড়িয়ে গেল।
গোবিন্দ একটু চাপাগলায় বলল, “তিন-তিনটে যক্ষিবুড়ি কেমন সুর করে কাঁদছে দেখেছ, ঠিক যেন কালোয়াতি গান।”
সামনে একটা বেঁটেমতো লোক দাঁড়ানো। সে মুখটা ফিরিয়ে বলল, “আহা, কাঁদবে না? তিন বুড়ির অন্ধের নাড়ি বোনপোটাকে যে ছেলেধরা এসে নিয়ে যাচ্ছে!”
গোবিন্দ চোখ বড় করে বলল, “নিয়ে গেছে?”
“এখনও নেয়নি, তবে নেবে। ছেলেধরাটা ঘরের মধ্যেই আছে।”
“বলো কী! তা ছেলেধরাটাকে ধরে–”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “উঁহু, উঁহু, সে উপায় নেই। ছেলেধরার পেল্লায় চেহারা। চার হাত লম্বা, আশি ইঞ্চি বুকের ছাতি, মুগুরের মতো হাত, পেল্লায় গোঁফ আর রক্তবর্ণ চোখ সব সময়ে ভাঁটার মতো ঘুরছে। হাতে একখানা তলোয়ারও আছে বলে শুনেছি।”