আর তার পরই হলধর বলতে শুরু করল, “শোনো হে, সাতকড়ি, শোনো হে নবেন্দ্র, দুটো মুশকোমতো লোক এদিকেই আসছে। তারা এলে তাদের মারধর করতে যেয়ো না। বরং তাদের বোলো, তারা যাকে খুঁজতে এসেছে সে বিপিনবাবুর বাড়িতে আছে।”
সাতকড়ি গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনার কি ভর হয়েছে হলধরবাবু?”
“হয়েছে। আমি এখন আর হলধর নই, অন্য লোক।”
“কে আপনি বলুন?”
“আমি পীতাম্বর বিশ্বাস।”
“কোন পীতাম্বর? নয়াপাড়ার পীতাম্বর নাকি?”
“সে-ই।”
“তোমার কাছে আমি পঞ্চাশটা টাকা পাই। জমির খাজনা দিতে ধার নিয়েছিলে, মনে আছে?”
“মরার পর কি কারও ঋণ থাকে সাতকড়ি?”
“খুব থাকে। তোমার বউকে শোধ দিতে বলো।”
“সে আমার কথা শুনবে ভেবেছ? যাক গে, যা বললাম মনে রেখো, দুটো লোক আসছে, ডাকাতটাকাত নয়। বিপিনবাবুর বাড়ির রাস্তাটা বলে দিয়ো।”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দরজার কড়া নড়ে উঠল। সাতকড়ি গিয়ে দরজা খুলতেই দুটো লোক তাকে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে পড়ল। হাতে দুজনেরই দুটো মস্ত ছোরা।
ঘটনার আকস্মিকতায় কী বলতে হবে তা ভুলেই গেল সাতকড়ি। তার ওপর সে ষণ্ডামাকা হলেও ছোরাছুরির মোকাবিলা করার সাহস নেই। সে তিন হাত পিছিয়ে আঁ-আঁ করতে লাগল। তার ভায়রাভাই নবেন্দ্র সুট করে টেবিলের তলায় ঢুকে পড়ল।
বুড়ো হলধরের মুখ দিয়ে পীতাম্বর তখন চেঁচিয়ে বলল, “আ মোলো যা, এরা ভয়ে সব ভুলে মেরে দিল। বলি ও গোবিন্দ, ও গোপাল, তোমরা যাকে খুঁজতে এসেছ সে এখানে নেই। সে আছে বিপিনবাবুর বাড়িতে।”
গোবিন্দ সোল্লাসে বলে উঠল, “গোপালদা, এই তো সেই বুড়ো!”
“তাতে আর সন্দেহ কী! আমাদের চিনতে পেরেছে। তোল, তোল, ঘাড়ে ফেলে নিয়ে ছুট দে।”
হলধর বিস্তর হাত-পা ছুড়ল এবং চেঁচিয়ে অনেক ভাল-ভাল কথা বলতে লাগল বটে, কিন্তু সুবিধে হল না। ভাঁজকরা কম্বলের মতো তাকে লহমায় কাঁধের ওপর ফেলে দাঁড়াল গোবিন্দ। আর গোপাল ছোট্ট একখানা লোহার মুগুর বের করে সস্নেহে এক ঘা সাতকড়ির মাথায়, আর নিচু হয়ে টেবিলের তলায় এক ঘা নবেন্দ্রর মাথায় বসিয়ে দিল। দুজনেই চোখ উলটে পড়ে রইল মেঝেয়।
নির্জন রাস্তা দিয়ে একরকম ছুটতে ছুটতে গাঁয়ের বাইরে এসে হলধরকে নামিয়ে দাঁড় করাল গোবিন্দ। তারপর দম নিতে নিতে বলল, “খুব তো কাঁধে চেপে নিলে কিছুক্ষণ! এবার হাঁটো তো চাঁদু। চটপট হাঁটো। কর্তাবাবু তোমার গদানের জন্য বসে আছেন।”
হলধর ওরফে পীতাম্বর খিঁচিয়ে উঠে বলল, “খুব কেরানি দেখালে যা হোক। পইপই করে বললুম, ওরে সেই অলুক্ষুনে বুড়ো বিপিনের বাড়িতে গ্যাঁট হয়ে বসে লুচি গিলছে, তা শুনলে সে কথা! আমার কোন দায় পড়েছিল আগ বাড়িয়ে খবর দেওয়ার? একটু মায়া পড়েছিল বটে, কিন্তু টানাহ্যাঁচড়ায় সেটাও গেছে। যাও, এবার গিয়ে কাবাবুর লাথি ঝাঁটা খাও গিয়ে। গতরখানাই যা বানিয়েছ, ঘিলুর জায়গায় তো আরশোলা ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
গোবিন্দ হলধরকে একখানা মৃদু রা মেরে বলল, “আর মেলা ফটফট করতে হবে না। পা চালিয়ে চলো তো বাছাধন!”
পীতাম্বর ভারী হতাশ হয়ে হলধরের কান দিয়ে বেরিয়ে এল। খামোখা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আজ আবার নিশুত রাতে মথুরাপুরে শিবু দাসের গুদামে শুঁটকি মাছ শুকতে নেমন্তন্ন করে গেছে সনাতন।
পীতাম্বর বেরিয়ে আসতেই হলধর চেতনা ফিরে পেয়ে চারদিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাঁউ রে মাউ রে করে উঠল, “ওরে বাবা রে! এ আমি কোথায় এলুম রে! কারা ধরে আনল রে! ভুত নাকি রে তোরা! ভূত! পায়ে ধরি বাবা ভূত, সাত জন্মেও আর প্ল্যানচেট করব না…”
পীতাম্বর খুবই ক্ষুব্ধ চিত্তে দৃশ্যটা দেখছিল। হলধর চেঁচাচ্ছে আর দুই গুণ্ডা তার দু হাত ধরে টানাটানি করছে।
হঠাৎ গোপাল বলল, “দাঁড়া তো গোবিন্দ! আমার কেমন যেন একটা সন্দেহ হচ্ছে।”
“কীসের সন্দেহ?”
“ওর টুপিটা খোল, মুখোনা ভাল করে দেখি।”
“কেন বলো তো?”
“এ সেই লোক না-ও হতে পারে। ভজনবুড়ো এত দুবলা নয়। মনে আছে, গতকাল রাতে কেমন আমাদের হাত ফসকে পিছলে বেরিয়ে গেল!”
‘তা বটে। তা হলে দ্যাখো।” বলে গোবিন্দ একটানে বাঁদুরে টুপিটা খুলে ফেলল। গোপাল একখানা দেশলাইকাঠি ফস করে মুখের সামনে ধরতেই হলধর কাঁপতে কাঁপতে বলল, “না বাবা, আমি সে-লোক নই। জন্মেও আমি সে-লোক ছিলাম না। সে-লোকগুলো যতটা খারাপ হয়, আমি ততটা নই বাবারা।“
ভাল করে দেখে গোপাল একটা খাস ছেড়ে বলল, “না রে, এ সে লোক নয়। ভজনবুডোর বয়স একশো তিরিশ বছর, আর এ তো আশি বছরের খোকা।”
গোবিন্দ বলল, “তা হলে তো সাত হাত জল গো গোপালদা! এখন সে-লোককে পাই কোথা?”
হলধর হঠাৎ শুনতে পেল, কে যেন বলে দিচ্ছে, “বিপিনবাবুর বাড়ি, বিপিনবাবুর বাড়ি..”
হলধর কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বিপিনবাবুর বাড়িতে যাও বাবা, বিপিনবাবুর বাড়িতে মেলা সে-লোক। সে-লোকে একেবারে গিজগিজ করছে।”
গোবিন্দ বলল, “তখন থেকে কেবল শুনছি বিপিনবাবুর বাড়ি, বিপিনবাবুর বাড়ি। চলো তো চাঁদু, বাড়িটা একবার দেখিয়ে দাও তো।”
হলধর বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, “তা আর বলতে! আস্তাজ্ঞে হোক, আস্তাজ্ঞে হোক। এই যে এ-দিকে।”
পীতাম্বর হাঁফ ছেড়ে বলল, “যাক বাবা, আর একটু হলেই শুঁটকি মাছের গন্ধ শোঁকার নেমন্তন্নটা ভেস্তেই যাচ্ছিল।”
হলধর সোজা তাদের নিয়ে গিয়ে বিপিনবাবুর বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “এই বাড়ি।”
৪. মাসির মুখে হাসি নেই
হাসিরাশি মাসির মুখে হাসি নেই, বরং রাশি রাশি দুঃখ। হাসিখুশি মাসির খুশি উবে গিয়ে ফাঁসির আসামির মতো মুখের চেহারা। কাশীবাসী মাসির কাশী রওনা হওয়ার মতোই অবস্থা। তিন মাসি ভেতরবাড়িতে বারান্দায় গোল হয়ে বসে ডাক ছেড়ে কাঁদতে লেগেছেন। কান্নার শব্দে পাড়াপ্রতিবেশীরাও জড়ো হয়েছে। মাসিদের মাঝখানে সোজা হয়ে বসে চিতেন সবাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।