“ইংরেজি ভুল বলি না ঠিক বলি তা ধরার মতো বিদ্যে ব্যোমকেশের পেটে নেই। সেটা তুমিও জানো। খামোখা চটেমটে আমার ওপর ঝাল ঝাড়ছ কেন? মাথা ঠাণ্ডা করে বসে আসল কথাটা শোনো।”
জয়ধ্বনি ফুঁসছিলেন। তবে বসেও পড়লেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে এরকম ঝগড়া রোজই হয়। মাঝে-মাঝে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। আবার গুটিগুটি এ-ওঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়ে লাজুক লাজুক মুখ করে, হাঁক দেন, “ভায়া, আছ নাকি?” জয়ধ্বনির মাথাটা একটু বেশি গরম, শ্যাম লাহিড়ী ভারী ঠাণ্ডা মাথার লোক।
জয়ধ্বনি বসে কোঁচা দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, পটাশগড়ের কথা কী যেন বলছিলে? যা-ই কেন বলো না, ওসব কথায় আমার কিন্তু তেমন বিশ্বাস নেই।”
“বিশ্বাস করা না করা তোমার ইচ্ছে। তবে জায়গাটা সুবিধের নয়।”
জয়ধ্বনি চিন্তিতভাবে বললেন, “বাঘ-ভালুকের ভয় অবশ্য আছে। কিন্তু আমার ধারণা, কালু খুব চালাক ষাঁড়, সে জয়পতাকাকে পিঠে নিয়েই ঠিক ফিরে আসবে।”
“তাও আসতে পারে। তবে আধঘণ্টা আগে খবর পেলুম, কালু ফিরে এসেছে। বাজারে ঢুকে কার যেন সাতটা মোচা চিবিয়ে খেয়েছে। সঙ্গে কয়েক কেজি চালও সাপটে নিয়েছে। এখন বটতলায় বসে জিরেন নিচ্ছে।”
জয়ধ্বনি পাংশুমুখে বললেন, “তা হলে?”
“সেইটেই তো কথা।”
“আমার মনে হয়, জয়পতাকা কালুর পিঠ থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরে গেছে।”
“অসম্ভব নয়। তবে যদি বাড়ি না ফিরে থাকে তা হলে ঘাবড়ে যেও না।”
জয়ধ্বনি বুক ফুলিয়ে বললেন, “মোটেই ঘাবড়ে যাইনি। জয়পতাকা যে বীরত্বের কাজ করেছে তাতে আমার স্থির বিশ্বাস, সে বিপদে পড়লেও বেরিয়ে আসতে পারবে।” শ্যা
ম লাহিড়ী খুশি হয়ে বললেন, “শাবাশ!”
এই সময়ে কাজের লোক এসে বলল, “হেডসার বিষ্ণুবাবু দেখা করতে এসেছেন।”
শ্যাম লাহিড়ী তটস্থ হয়ে বললেন, “নিয়ে আয়।”
বিষ্ণুবাবু একা নন, সঙ্গে আরও দু’জন মাস্টারমশাই এসে ম্লানমুখে ঢুকলেন। বিষ্ণুবাবু বললেন, “জয়পতাকাকে নিয়ে কালু পটাশগড়ের জঙ্গলে ঢুকেছিল বলে খবর পেয়েছি। রাখাল ছেলেরা দেখেছে। কালু একটু আগে ফিরে এলেও জয়পতাকা ফেরেনি। আমরা বেশ ভাবনায় পড়েছি। কাল ছুটি বটে, কিন্তু পরশু থেকে স্কুলে অঙ্ক করানোর ভাল লোক নেই।”
জয়ধ্বনি ফুঁসে উঠে বললেন, “শুধু অঙ্কই বা কেন, অ্যারিথমেটিক, জিওগ্রাফি, জিওমেট্রি, অ্যালজেব্রা, ম্যাথমেটিকস, ভূগোল, ইতিহাস, সায়েন্স, হিস্টরি, বিজ্ঞান এসবও তো সে পড়ায়।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
শ্যাম লাহিড়ী একটু ভেবে বললেন, “যদি গড়-ভুতুয়ার পাল্লায় পড়ে না থাকে তা হলে চিন্তা নেই।”
“গড়-ভুতুয়াটা কী বস্তু হে!”
“গড়-ভুতুয়া নামটা আমারই দেওয়া। পটাশগড়ের জঙ্গলে একটা পুরনো কেল্লা আছে বলে শোনা যায়। এমনিতে সেখানে যাওয়া যায় না। তবে গড়-ভুতুয়া ধরলে যেতেই হয়। সেটা ভারী মিস্টিরিয়াস জায়গা।”
জয়ধ্বনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহা, গড়-ভুতুয়াটা কী জিনিস সেটা বলবে তো! ভূত নাকি?”
“তার চারদিকে গহিন চোরাবালি। একটা মাত্র সরু পথ আছে। কিন্তু সেটা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। গড়-ভুতুয়া যদি নিয়ে যায় তো ভাল, কিন্তু বেরোবার সময় সে কিছুতেই পথ দেখায় না। তখনই বিপদ। আমার চেনা-জানা তিনটে সাহেব সেখান থেকে আর ফেরেনি।”
জয়ধ্বনি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, “আমি ওসব গাঁজাখুরিতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু এর একটা বিহিতও তো করা দরকার।”
বিষ্ণুবাবু বললেন, “স্কুলের বড় ছেলেরা অবশ্য সবাই লাঠি-সোটা, টর্চ, হ্যারিকেন নিয়ে পটাশগড়ের জঙ্গলে গেছে। শহরের আরও কিছু ডাকাবুকো লোকও আছে তাদের সঙ্গে। খুঁজে পেলে নিয়ে আসবে।”
শ্যাম লাহিড়ী চিন্তিত মুখে একটা দাবার ঘুটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন।
জয়ধ্বনি উঠে পড়ে বললেন, “তা হলে আমিও ঘরে বসে থাকতে পারব না। আমার নাতির যদি বিপদ হয়, তা হলে আর আমার বেঁচে থাকার মানেই হয় না। আমি চললুম।”
শ্যাম লাহিড়ী বললেন, “গেলেই তো হবে না। আটঘাট বেঁধে যেতে হবে। বোসা জয়ধ্বনি। আমিও তৈরি হয়ে নিই।”
“তুমি যাবে!”
“আমার যাওয়াটা বিশেষ দরকার। পটাশগড়ের জঙ্গলে আমি তবু বারকয়েক গেছি, অন্য সবাই আনাড়ি।”
জয়ধ্বনি বসে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে বললেন, “যদি বাঘে তাকে ধরে তো পিটিয়ে ছাতু করব।”
শ্যাম লাহিড়ী মৃদু হেসে বললেন, “জঙ্গলে মেলা বড় গাছ আছে। তার একটায় উঠে পড়লে বাঘ তেমন কিছু করতে পারবে না। জয়পতাকা বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু আমার ভয় অন্য। গড়-ভুতুয়া বড় পাজি জিনিস। লোককে বেভুল ভুলিয়ে-ভালিয়ে গড়ে নিয়ে তোলে। আমাকেও চেষ্টা করেছিল। সেবার আমার হাউন্ড কুকুর জিমি সঙ্গে থাকায় বেঁচে যাই। সে আমার প্যান্ট কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে এসেছিল। থাকগে সেসব কথা। শুনুন। বিষ্ণুবাবু, আমি পটাশগড়ের জঙ্গলে যাচ্ছি। কিন্তু সঙ্গে ব্যোমকেশকেও যেতে হবে। আপনারা তাঁকে গিয়ে বলুন।”
বিষ্ণুবাবু বললেন, “উনি যাবেন বলে মনে হয় না। ভারী ভীতু লোক। তার ওপর কাল ওঁর দু-দুটো সভা। একটা জয়পতাকা সংবর্ধনা সভা, আর-একটা জয়পতাকা ধিক্কার সভা। উনি এখন দু-দুটো বক্তৃতা মুখস্থ করছেন।”
শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর মুখে বললেন, “তা বললে চলবে না। ব্যোমকেশকে গিয়ে বলুন যে, সে যদি না যায় তা হলে সে কাপুরুষ বলে ভোটারদের কাছে রটিয়ে দেব, ভোটাররা আর তাকে ভোট দেবে না।”