জয়ধ্বনি একটু বিপাকে পড়ে মাথা চুলকে বললেন, “কালুর বয়স! তা মন্দ হবে না। অনেককাল ধরেই তো তাকে দেখছি।”
“আমার হিসেবমতো সত্তরের ওপর। আশির কাছাকাছি।”
“তা হবে, তাতে কী?”
“তোমার নাতি যে কালুকে জব্দ করেছে বলে খুব বড়াই করছ, তুমি কি জানো যে, কালুর চোখে ছানি এসেছে। তার ব্লাডপ্রেশারও বেশ হাই! হার্টেরও একটু গোলমাল আছে। সে সুস্থ সবল এবং তরুণ হলে জয়পতাকা কি তাকে কাবু করতে পারত?”
জয়ধ্বনি হাঁ করে কিছুক্ষণ শ্যাম লাহিড়ীর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “কালুর চোখে ছানি? প্রেশার!! হার্ট-ট্রাবল? ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাওনি? তোমার সঙ্গে দাবা খেলতে বসাই আমার ভুল হয়েছে। আমি চললুম।”
এই বলে রাগ করে জয়ধ্বনি দাবার খুঁটি হাটকে-মাটকে দিয়ে উঠে পড়লেন।
শ্যাম লাহিড়ী খুব শান্ত গলায় বললেন, “তোমার রাগের কারণও জানি। এই চালটা তুমি বাঁচাতে পারতে না। আমার গজ পরের চালেই তোমার রাজা-মন্ত্রী একসঙ্গে ধরত, সেই ভয়েই না উঠে পড়লে।”
জয়ধ্বনি রাগের চোটে লাটুর মতো বোঁবোঁ করে দুটো চক্কর খেয়ে নিয়ে বললেন, “আমাকে ঘাঁটিও না বলছি লাহিড়ী। রাজা-মন্ত্রী ধরলেই হল? আমি তোমার ও চাল অনেক আগেই দেখে নিয়েছি। রাজা-মন্ত্রী ধরলে ঘোড়া দিয়ে চাল চাপা দিতুম। তারপর বোড়ে ঠেললেই তোমার গজ লেজ তুলে পালিয়ে যেত, যেমন আমার নাতির পাল্লায় পড়ে কালু পালিয়েছে। বুঝলে?”
শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাগ কোরো না। বোসো। কালু পালিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তোমার নাতিকে পিঠে নিয়েই পালিয়েছে। ব্যাপারটা আমার সুবিধের ঠেকছে না। যতদূর খবর পেয়েছি, কালু জয়পতাকাকে পিঠে নিয়ে উত্তর দিকে গেছে। ওদিকটায় পটাশগড়ের জঙ্গল। জায়গাটার খুব সুনাম নেই, তুমিও জানো।”
জয়ধ্বনি এবার একটু নরম হলেন। বসলেনও। তারপর বললেন, “পটাশগড়ের জঙ্গলেই যে ঢুকেছে তার তো কোনও প্রমাণ নেই।”
শ্যাম লাহিড়ী মাথা নেড়ে বললেন, “নেই। তবে তোমাকে যা বললুম তা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিও না। কালুর চোখে ছানি পড়েছে কি না বা তার রক্তচাপ আছে কি না, তা জানি না। কিন্তু খ্যাপা ষাঁড় খুবই ভয়ঙ্কর। তার দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না। যদি পটাশগড়ের জঙ্গলেই ঢুকে থাকে, তা হলে একটু ভাবনার কথা। তোমার নাতি যত বীরই হোক, তাকে আমি বেজায় ভীতু বলেই জানি।”
জয়ধ্বনি এবার চিন্তিত মুখে কোঁচার খুঁট দিয়ে মুখোনা মুছে বললেন, “এ তো বেশ ভাবনায় ফেললে ভায়া।”
শ্যাম লাহিড়ী খুবই বিষণ্ণ মুখে বললেন, “আমি যখন শিকার করতুম তখনও পারতপক্ষে পটাশগড়ের জঙ্গলে যেতুম না। যেবারকয়েক ওখানে ঢুকেছি, প্রতিবারই নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।”
“কীরকম অভিজ্ঞতা?”
“শুনলে তুমি তোমার নাতির জন্য দুশ্চিন্তা করবে।”
জয়ধ্বনি একটু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “ওটা বলে তো দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিলে। পটাশগড় সম্পর্কে আমিও নানারকম শুনে আসছি বহুকাল ধরে। তা বলে বিশ্বাস করিনি।”
শ্যাম লাহিড়ী মৃদু হেসে বললেন, “তুমি হচ্ছ কুনো বীর। ঘরে বসে ধারণা তৈরি করো, বিশ্বাস করো না ভাল কথা, কিন্তু পটাশগড়ের জঙ্গলে তুমি ঢোকোওনি কোনওদিন। কেন ঢোকোনি জানো? ভয়ে।”
জয়ধ্বনি মহা খাপ্পা হয়ে ফের উঠে পড়লেন, “ভয়! ভয়! আমাকে তুমি ভয়ের কথা বলছ? যদি ভীতুই হতুম হে, তা হলে আমার নাতি আজ এত বড় বীর বলে নাম করতে পারত না। আর জঙ্গলেই বা কেন আমাকে যেতে হবে হ্যাঁ! আমি কাঠুরে না মউলি, না তোমার মতো শেয়াল-তাড়য়া শিকারি যে জঙ্গলে-মঙ্গলে ঘুরে নিজেকে বড় বীর বলে জাহির করতে হবে? আর তোমার বীরত্বও খুব জানা আছে। সেবার ফাগু সিং যখন কুস্তি লড়তে এল, সেবার তো বাপু ন্যাজ দেখিয়েছিলে। ঘর থেকে বারটি পর্যন্ত হলে না। ফাগু সিং লজ্জায়, ঘেন্নায় শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বলে গেল, লাহিড়ীবাবুকে আমি বীর বলে শুনেছিলুম। আরে ছছাঃ, এ তো দেখছি এক নম্বরের ডরফোক লোক।”
শ্যাম লাহিড়ী চোখ বুজে ছিলেন। মৃদুমৃদু মাথা নেড়ে বললেন, “ফাগু সিং যখন এসেছিল তখন আমি এ-শহরে ছিলুম না। যদি থাকতুম, তা হলে ফাগু সিংকে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিতুম।”
“ছিলে না মানে? আলবাত ছিলে! তবে ঘরের মধ্যে পালিয়ে ছিলে।”
“বোসো হে বোসো। নিজেকে বীর বলে জাহির করার কোনও দরকারই নেই আমার। বিশ বাইশ বছর আগেকার খবরের কাগজ খুললে দেখতে পাবে যে, ফাগু সিংকে আমি অন্তত চারবার হারিয়েছি। সে এ-শহরে এসেছিল শেষবারের মত আমাকে হারানোর চেষ্টা করতে।”
কথাটা যে মিথ্যে নয় তা জয়ধ্বনি জানেন। বাস্তবিকই ফাগু সিং-এর মতো দুর্দান্ত কুস্তিগিরকে একসময়ে শ্যাম লাহিড়ী পটাপট হারিয়ে দিতেন। তবু জয়ধ্বনি ফের টেবিলে চাপড় মেরে বলেন, “সবাই জানে রামগড়ের জঙ্গলে তুমি যে বাঘটা মেরেছিলে সেটা ফোকলা ছিল। তার একটাও দাঁত ছিল না। সেই বাঘটাকে তুমি ম্যান ইটার বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলে।
শ্যাম লাহিড়ী মাথা নাড়তে-নাড়তে বললেন, “রামগড়ের বাঘটা মোটেই ফোকলা ছিল না। তার দুটো সামনের দাঁত কোনও কারণে ভেঙে গিয়েছিল। তাতে মানুষ খেতে তার কোনও অসুবিধে হত না। সে কড়মড় করে হাড়গোড় গুঁড়িয়েই মানুষ খেত।”
জয়ধ্বনি হার মানার লোক নন। সতেজে বললেন, “আর ইংরেজি বলতে পারো বলে যে তোমার বড় অহঙ্কার, সেটাও ঠিক নয়। ব্যোমকেশ তো সেদিনও বলছিল, শ্যাম লাহিড়ী সাহেবদের সঙ্গে খুব ফটাফট ইংরেজি বলে বটে, কিন্তু সব ভুল ইংরেজি। শুনে সাহেবরা আড়ালে হাসে।”