বেশ বোঝা যাচ্ছিল চোরাবালির ভিতর দিয়ে একটি সরু চোরাপথ রয়েছে কেল্লার যাওয়ার জন্য। সেটা হাতখানেকের চেয়ে বেশি চওড়া নয়। বেভুলে একটু এদিক-ওদিক পা ফেললেই বেমালুম বালির মধ্যে গায়েব হয়ে যেতে হবে। জয়পতাকা শেয়ালটার পিছু পিছু চলতে লাগলেন। কেল্লার জমিতে যখন পা রাখলেন, তখন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় তাঁর ঘাম হচ্ছে।
কিন্তু চারদিকে বালিয়াড়ির মধ্যে চমৎকার মরুদ্যানের মতো বাগান দেখে জয়পতাকার প্রাণ জুড়িয়ে গেল, ভারী সুন্দর বাগান। পাথরে বাঁধানো ফোয়ারা থেকে জল ছড়িয়ে পড়ছে গোল পাথরের চৌবাচ্চায়। কেল্লাটি বেশ ছোট। শ্বেতপাথরের চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। সামনেই সিংহদরজা। জয়পতাকা নির্বিঘ্নে সিংহদরজায় পৌঁছে চারদিকে চাইলেন। কোনও পাহারাদার নেই। মানুষজন নেই। কিন্তু ভিতরে ঘরে-ঘরে ঝাড়বাতির উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। একটা পিয়ানোর মিষ্টি শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ক্ষুধাতুর ক্লান্ত জয়পতাকা ভিতরে ঢুকলেন।
“আসুন, আসুন, ডান দিকে ডাইনিং-হল। ঢুকে পড়ন!” সেই মোলায়েম গলা।
জয়পতাকা চারদিকে আবার চাইলেন। কেউ নেই। ডান দিকে একটা টানা চওড়া বারান্দা। ঝকঝক করছে পরিষ্কার। বারান্দা পেরিয়েই মস্ত লম্বা ডাইনিং-হল। অন্তত পঞ্চাশজন বসে খেতে পারে এত বড় মেহগনির টেবিল। তার ওপর মোমদানিতে সার সার মোম জ্বলছে। ওপরে জ্বলছে অন্তত দশটা ঝাড়বাতি। টেবিলের ওপর থরেথরে খাবার সাজানো। গন্ধে বাতাস ম-ম করছে। কিন্তু কেউ নেই।
জয়পতাকা থমকে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, টেবিলের চারধারে সাজানো চেয়ারের মধ্যে একটা চেয়ার কে যেন পিছনে টেনে সরিয়ে দিয়েছে।
“বসুন। ডিনারের সময় হয়েছে।” সেই বিনয়ী গলা। হঠাৎ একটি মিষ্টি গং বেজে উঠল অলক্ষ্যে।
জয়পতাকা সম্মোহিতের মতো টানা চেয়ারটায় বসলেন। ভারী অস্বস্তি হচ্ছে। গা-ছমছম করছে। আবার খিদেও ভয়ানক। একটু দ্বিধাগ্রস্ত হাতে তিনি চামচ তুলে নিলেন। তারপর খাওয়া শুরু করলেন।
৩. রাতে রোজকার মতো দাবা খেলতে বসে
রাতে রোজকার মতো দাবা খেলতে বসে জয়ধ্বনি বললেন, “বুঝলে লাহিড়ী, তুমি বয়সকালে অনেক শেয়াল-টেয়াল মেরেছ। বটে, রোগাপটকা লোকদের ধরে ধরে এনে কুস্তিতেও হারিয়েছ, কিন্তু আমার নাতি জয়পতাকা আজ যা কাণ্ড করেছে শুনলে তোমার নিজের জন্য দুঃখ হবে।”
শ্যাম লাহিড়ী খুব গম্ভীর মুখে বললেন, “তোমার নাতির ঘটনা সবই শুনেছি। কিন্তু বয়সকালে আমি মোটেও শেয়াল মারিনি। মেরেছি পাগলা হাতি আর মানষুখেকো বাঘ।”
জয়ধ্বনি খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “রাখো রাখো। মেরেছ তো বন্দুক দিয়ে। ভারী বাহাদুরি। বাঘের তো দাঁত-নখ ছাড়া কিছু নেই, হাতি বেচারার সম্বল শুধু গায়ের জোর আর গুঁড়, তাদেরও যদি রাইফেল বন্দুক থাকত তা হলেও না হয় বুঝতাম। পারবে আমার নাতির মতো খালি হাতে লড়তে? আমি তো জয়পতাকাকে একটা সোনার মেডেল দেব বলেছি। একটু আগে ঊ্যাড়া পিটিয়ে গেল, শুনেছ? জয়পতাকাকে পরশু নাগরিক সংবর্ধনাও দেওয়া হবে।”
“শুনেছি। আরও শুনেছি, ওইদিনই আবার জয়পতাকাকে নিন্দা করে আর-একটা সভায় একটা প্রস্তাবও নেওয়া হবে। ওই মর্কট ব্যোমকেশ দুটো সভারই সভাপতি।”
“কিছু লোক হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরছে। তারাই করছে ওসব।”
শ্যাম লাহিড়ী একটা বড় শ্বাস ফেলে বললেন, “জয়পতাকা খুব ভাল ছেলে। শুনেছি তার অঙ্কের মাথা খুব সাফ।”
“শুধু অঙ্ক? অঙ্ক ম্যাথমেটিক্স অ্যালজেব্রা, জিওমেট্রি, পাটীগণিত, জ্যামিতি, অ্যারিথমেটিক, বীজগণিত কোনটায় নয় বলো! শুনেছি ভূগোল, ইতিহাস এসবও তার মাথায় খুব খেলে। বিজ্ঞান বলে বিজ্ঞান, সায়েন্স বলল সায়েন্স, কোনটায় সে কার চেয়ে কম?”
শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর মুখে বললেন, “দ্যাখো জয়ধ্বনি, তুমি সেই যে কাশীর টোলে সংস্কৃত শিখে এসেছিলে, তারপর আর দুনিয়ার কিছুই শেখোনি।”
জয়ধ্বনি ফের খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “যে সংস্কৃত শিখেছে তার আবার কিছু শেখার আছে নাকি? সংস্কৃত হচ্ছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, দুপাতা ইংরেজি, দুপাতা অঙ্ক শিখলেই বুঝি চতুর্ভুজ হওয়া যায়? এই যে তুমি এত শিখলে, গাদাগাদা পড়া মুখস্থ করলে, তা পারলে ব্যোমকেশের মতো মুখ্যর সঙ্গে এঁটে উঠতে? তুমি এত শিখে বুড়ো বয়সে ঘরে বসে বসে লেজ নাড়ছ, আর ওদিকে ব্যোমকেশ পৌরপিতা হয়ে কত জায়গায় দাবড়ে বক্তৃতা দিয়ে আসর গরম করে বেড়াচ্ছে।”
শ্যাম লাহিড়ী মৃদু মৃদু হেসে বললেন, “ভুলে যাচ্ছ কেন যে, এটা কলিযুগ! কলিযুগে কী হয় জানো? যত ভাল লোক সবাই মাথা নিচু করে থাকে। আর খারাপ, মুখ্য, অপদার্থরা দাবড়ে বেড়ায়।”
“ওসব হচ্ছে হিংসুটেদের মতো কথা। ব্যোমকেশের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে তুমি এখন কলিযুগের দোহাই দিচ্ছ। কলিযুগ তো কী? এই কলিযুগেই তো আমার নাতি কত বড় একখানা কাণ্ড করে দেখাল।”
শ্যাম লাহিড়ী নিমীলিত চোখে চেয়ে বললেন, “তোমার নাতি হল সাক্ষাৎ কল্কি অবতার। তা সেই জাম্বুবানটা কালুর পিঠে চেপে গেলই বা কোথায়?”
“সে কালুকে দেশছাড়া করে তবে ফিরবে।”
শ্যাম লাহিড়ী মৃদু একটু হেসে বললেন, “তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কালুর কত বয়স তা জানো?”