খাদের মধ্যে অন্ধকার আরও জমাট, আরও নীরেট। জয়পতাকা চারদিক হাতড়ে হাতড়ে বুঝতে পারলেন, তিনি পড়েছেন রাজ্যের জমে থাকা শুকনো নরম পাতা আর পচা ডালপালার ওপর। সেটা এতই নরম যে, ফোমরবারের গদিকেও হার মানায়। জয়পতাকাবাবুর ইচ্ছে হচ্ছিল, এখানে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেন।
কিন্তু সেই মোলায়েম কণ্ঠস্বর এখানেও সঙ্গ ছাড়েনি। বলে উঠল, “ডিনারের গং বেজে যাবে যে; সাহেব ভারী রাগ করবেন।”
কণ্ঠস্বরটি যারই হোক লোকটি হয়ত তেমন খারাপ নয়। তা ছাড়া ডিনারের কথাও বলছে। জয়পতাকার পেটে এখন দাউদাউ খিদে। সুতরাং একটু দম নিয়ে তিনি খাদ থেকে উদ্ধারের ফিকির ভাবতে লাগলেন। আপাতদৃষ্টিতে এই গভীর খাদ থেকে উদ্ধারের কোনও পন্থাই নেই। যদিও বা থাকে, এই অন্ধকারে তা খুঁজে পাওয়ার ভরসা নেই। লতাপাতা বেয়ে যদি ওপরে উঠতে হয় তা খুঁজে পাওয়ার ভরসা নেই। লতাপাতা বেয়ে যদি ওপরে উঠতে হয় তা হলেও জয়পতাকা পেরে উঠবেন না। তাঁর গায়ে আর জোর নেই। জীবনেও তিনি ব্যায়াম-ট্যায়াম করেননি। কেবল বই পড়েছেন।
“এগোলেই হবে, পথ পেয়ে যাবেন।” সেই মোলায়েম গলাটি বলল। জয়পতাকা সুতরাং ব্যাজার মুখ করে এগোলেন। সরু খাদ লম্বা একটা গলির মতো। কোনও সময়ে ভূমিকম্পের ফলে মাটিতে গভীর ফাটল ধরেছিল। সেটাই এখন হাঁ করা খাদ। দু’দিকে হাত বাড়ালেই এবড়োখেবড়ো দুটো দেওয়ালই স্পর্শ করা যায়। জয়পতাকা এরোপ্লেনের মতো দুদিকে হাত বাড়িয়ে সাবধানে এগোতে লাগলেন। দশ বারো পা হাঁটতেই ডান-ধারে আর-একটা গলি। কে যেন সেই গলির ভিতর থেকে চাপা গলায় বলে উঠল, “আসুন, এই পথ।”
জয়পতাকা অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে ঢুকে পড়লেন গলির মধ্যে। কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু পায়ের নিচে বেশ মসৃণ মাটি।
একটা ঢালু বেয়ে ধীরে-ধীরে ওপরের দিকে উঠে গেছে।
কতক্ষণ ধরে যে হাঁটতে হল তা জয়পতাকার হিসেব নেই। হাঁটছেন তো হাঁটছেনই। পথ আর ফুরোচ্ছে না। জয়পতাকার বুদ্ধি-বিবেচনা তেমন কাজ করছে না। মাথাটা কেমন ধোঁয়া-ধোঁয়া লাগছে। ধকল তো বড় কম যায়নি। তিনি যন্ত্রের পুতুলের মতো হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
হঠাৎ মনে হল, পথ শেষ হয়েছে। সামনে ফাঁকা জমি। চোখ কচলে জয়পতাকা চাইলেন। দেখলেন, বেশ মাখোমাখো একটু চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে। সামনে ঝোঁপঝাড় থাকলেও তেমন বড় গাছপালা নেই। আর জ্যোৎস্নায় অনেকটা বালিয়াড়ি চিকচিক করছে।
জয়পতাকা আরও কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। দৃশ্যটা খুবই রহস্যময়। বালিয়াড়ির ঠিক মাঝখানে একটা বাড়ির মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। বেশ বড় বাড়ি। তবে অন্ধকার। জ্যোৎস্নায় সেটাকে ধ্বংসপ্প বলেই মনে হতে লাগল তাঁর।
জঙ্গলের মধ্যে হরিণের গলা ঝাড়বার মতো বিশ্রী ‘হ্যাক হ্যাক’ ডাক শুনতে পেলেন। তারপরই চাপা একটা গর্জন। এক শিঅলা হরিণ তীরবেগে পিছনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে বালিয়াড়িতে পড়ে ছুটতে লাগল। কিন্তু দশ কদমও যেতে পারল না। জয়পতাকা বিস্ময়ে গোলাকার চোখে দেখলেন হরিণটার চারটে পা বালিতে বসে গেল। তারপর পেট অবধি, তারপর সমস্ত শরীরটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডে অদৃশ্য হয়ে গেল বালির তলায়। একটা চিতা বাঘ বালিয়াড়ির ধারে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার জঙ্গলে ঢুকে গেল।
জয়পতাকা শুকনো মুখে একটা ঢোঁক গিললেন, এই সাঙ্ঘাতিক চোরাবালির মাঝখানে বাড়ি তৈরি করেছিল কে? কীভাবেই বা করল?
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল। পটাশগড় নামটা যা থেকে হয়েছে তা আসলে একটা কেল্লা। এই কেল্লার নামই পটাশগড়। শোনা যায় সাধারণত কেল্লার চারধানে পরিখা থাকে, পটাশগড়ের চারধারে পরিখা ছিল না ছিল চোরাবালি। কেল্লা যারা আক্রমণ করতে আসত তাদের সমাধি রচিত হত চোরাবালিতে। পটাশগড়ে তাই বাইরের শত্ৰু কখনও ঢুকতে পারত না। কিন্তু এ-গল্প কিংবদন্তি বলে জয়পতাকা বিশ্বাস করেননি। তা হলে কি এই সেই কুখ্যাত পটাশগড়?
জয়পতাকা অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইলেন। চারদিকে হাহাকারের মতো চোরা বালিয়াড়ি। মাঝখানে একটা ধ্বংসস্তূপ,
কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে মৃদু জ্যোৎস্নায়!
“ডিনারের আর দেরি নেই। সময় হয়ে এল।”
জয়পতাকা চারদিকে এস্ত হরিণের মতো তাকালেন। ফাঁকা জায়গা, কেউ লুকিয়ে থাকলেও আন্দাজ করতে পারবেন। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। ফের যখন বাড়িটার দিকে ফিরে তাকালেন জয়পতাকা, তখন তাঁর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। ধ্বংসস্তূপ আর নেই। সেই জায়গায় ছোট্ট একটা দোতলা কেল্লা যেন দুধে স্নান করে ঝকঝক করছে। ঘরে-ঘরে বাতি জ্বলছে। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে!
“যান, সামনেই রাস্তা। সাহেব অপেক্ষা করছেন।”
“কে আপনি?” হুঙ্কার দিলেন জয়পতাকা।
কেউ জবাব দিল না। একটা দমকা বাতাস হা হা করে বয়ে গেল শুধু।
জয়পতাকা ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। কিন্তু পারলেন। পায়ে-পায়ে তিনি এগিয়ে যেতে লাগলেন সম্মোহিতের মতো।
আশ্চর্যের বিষয়, তিনি বালিয়াড়িতে নামবার আগেই একটা শেয়াল কোত্থেকে এসে তাঁর আগে নেমে পড়ল। তারপর তাঁর দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে দুলকি চালে চলতে লাগল।
চোরাবালিতে শেয়ালটা ডুবল না।
জয়পতাকা শেয়ালটার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন। পায়ের নিচে বেশ শক্ত আঁট বালি। কোথাও তেমন ভুসভুসে নয়। তা হলে কি ধরে নিতে হবে যে, চারদিকে চোরাবালি থাকলেও কেল্লায় যাওয়ার একটা রাস্তা আছে? জয়পতাকা তাঁর পকেট থেকে একটা কাঁচা টাকা বের করে পাশে দেড়ফুট তফাতে ছুঁড়ে দিলেন। সেটা ভুস করে ডুবে গেল। জয়পতাকা তাঁর শস্তার কলমটাও ছুঁড়ে দিয়ে পরীক্ষা করলেন। সেটাও চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।