নামটা মনে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাদবাকি সবকিছুই সিনেমার ছবির মত তাঁর মনে পড়ে যেতে লাগল। মনে না পড়লেই অবশ্য ভাল ছিল, কারণ তাঁর এও মনে পড়ল যে, এই সেই ভয়াবহ মনুষ্যবর্জিত রহস্যময় পটাশগড়ের জঙ্গল। মনে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর গায়ে কাঁটা দিল ভয়ে। কার গলা একটু আগে শুনলেন তিনি? জয়পতাকাবাবু চারিদিকে তাকাতে লাগলেন। নিশ্চিদ্র
অন্ধকারে জোনাকি জ্বলছে। গাছপালায় বাতাসের সরসর শব্দ হচ্ছে। একটা হুতোম প্যাঁচা আর একঝাঁক শেয়ালের ডাক শোনা গেল। একটা কেমন বোঁটকা গন্ধও পাচ্ছেন জয়পতাকাবাবু।
তাঁর ভরসা এই যে, কাছাকাছি মানুষ আছে। একটু আগেই ভারী বিনয়ী আর মোলায়েম একটা মনুষ্যকণ্ঠ তিনি শুনতে পেয়েছেন।
জয়পতাকাবাবু গা’টা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, “কে? কেউ কি আছেন কাছাকাছি?”
কেউ কোনও জবাব দিল না। তবে চাপা হাসির একটা ভারী ক্ষীণ শব্দ শুনতে পেলেন জয়পতাকা। গায়ে আবার কাঁটা দিল। যতদূর জানা যায় সাহেবশিকারিরা অবধি এই জঙ্গলকে এড়িয়ে চলত। ডাকাবুকো শ্যাম লাহিড়ী একবার ঢুকেছিলেন। কী হয়েছিল কে জানে। শ্যাম লাহিড়ী ভারী চাপা স্বভাবের গম্ভীর মানুষ। কাউকে সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেননি। তবে নিজে আর কখনও ঢোকেননি এই জঙ্গলে।
জয়পতাকা খানিকক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকটা অন্ধকারে অনুভব করার চেষ্টা করলেন।
জঙ্গলটা শহরের উত্তর দিকে। সুতরাং তিনি যদি দক্ষিণ দিকে এগোন, তা হলে একসময়ে জঙ্গলের বাইরে গিয়ে পৌঁছতে পারবেন, কিন্তু দিক ঠিক পাবেন কী করে? এই ভয়ঙ্কর অন্ধকারে নিজের হাতের তেলো অবধি দেখা যাচ্ছে না যে! সুতরাং তিনি ঠিক করলেন নাক বরাবর এগিয়ে যাবেন। এক জায়গায় স্থির হয়ে থেকে এগনোই ভাল। পটাশগড়ের জঙ্গলে রাত কাটানোর কথা ভাবাই যায় না।
জয়পতাকা যেই পা বাড়িয়েছেন অমনি সেই মোলায়েম গলা যেন বলে উঠল, “ঠিকই যাচ্ছেন।”
গলাটা এত ক্ষীণ আর এত দূর থেকে এল যে, সেটা আসলে গলা না মনের ভুল তা বুঝতে পারলেন না জয়পতাকা। তবে তিনিও ভারী বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আপনি যদি আমাকে একটু সাহায্য করেন তবে ভারী ভাল হয়। বড় বিপদে পড়েছি।”
একথার কেউ জবাব দিল না। জয়পতাকা কিছুক্ষণ অপেক্ষা। করে হতাশ হয়ে এগোতে লাগলেন। বন-জঙ্গলে এগনো ভারী শক্ত। পদে পদে বাধা। ঝোঁপঝাড়, কাঁটাগাছ, লতাপাতা সবই পথ আটকায়। পায়ে লতা জড়িয়ে দু’বার মুখ থুবড়ে পড়লেন জয়পতাকা। তবে নিচে গাছের পাতা আর লম্বা ঘাসের নরম আস্তরণ আছে বলে তেমন ব্যথা পেলেন না। একবার খুব কাছ দিয়ে একটা মস্ত বড় প্রাণী দৌড়ে চলে গেল। দুবার ক্রুদ্ধ বাঘের গর্জন শুনতে পেলেন দূর থেকে।
বুকটা ভারী ঢিবঢিব করতে লাগল কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আজ বিকেলে যে দুঃসাহসের সঙ্গে উনি খ্যাপা ষাঁড়ের মোকাবিলা করেছেন, সেই সাহসের কিছু তো এখনও অবশিষ্ট আছে। সেই সাহসে ভর করেই জয়পতাকা এগোতে লাগলেন। এগনোর পথে কোনও বাধাই তাঁকে আটকাতে পারছিল না। হঠাৎ খানিকটা স্যাঁতসেঁতে জমি পেলেন পায়ের তলায়। কয়েক পা এগোতে ভচাত্ করে হাঁটু অবধি ডুবে গেল কাদায়। তারপর কোমর অবধি বরফ-ঠাণ্ডা জল। জয়পতাকা পরোয়া না করে শীতে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে গতি বজায় রাখলেন। অবশ্য এটা ঠিক শীতকাল নয়। শরৎকাল। তবু এইসব পাহাড়ি অঞ্চলে একটু ঠাণ্ডাই পড়ে যায় এসময়ে। জয়পতাকা শীত প্লাস ভয় প্লাস উৎকণ্ঠাতেও কাঁপছেন। হঠাৎ সামনে ভুশ করে একটা নীলচে আলো লাফিয়ে উঠল শুন্যে। ভুতুড়ে লণ্ঠনের মতো কিছুক্ষণ নিরালম্ব হয়ে দুলতে লাগল। তারপর নিবে গেল। ফের একটু দূরে আর-একটা আলো লাফিয়ে উঠল। অন্য কেউ হলে এই কাণ্ড দেখে চেঁচাত। জয়পতাকা আলেয়ার কথা জানেন। তাই চেঁচালেন না। যদিও প্রথম আলেয়াটা দেখে তাঁর চেঁচাতে ইচ্ছে। হয়েছিল।
জলা পার হতেই অনেকক্ষণ সময় লাগল। জয়পতাকা যেন পরিশ্রান্ত বোধ করছেন। জলা থেকে ডাঙায় উঠে একটু জিরিয়ে নেবেন কি না ভাবছেন, এমন সময় সেই মোলায়েম কণ্ঠস্বর বাতাসের ফিরফিসানির মতো বলে উঠল, “এখন যে নষ্ট করার মতো সময় নেই। সাহেবের ডিনারের সময় হয়ে এল।”
কথাটার মানে কিছু বুঝতে পারলেন না জয়পতাকা। তবে বসতে তাঁর আর সাহস হল না। কোমরের লাল সালুটা খুলে হাত-পা একটু মুছে নিয়ে ফের এগোতে লাগলেন। ধুতি-পাঞ্জাবি জলে ভিজে শপশপ করছে। দিগভ্রান্ত, শ্রান্ত, ক্লান্ত জয়পতাকা চলতে লাগলেন।
আচমকাই অন্ধকারে একবার পা বাড়াতেই তিনি টের পেলেন, সামনে মাটি নেই। পা’টা টেনে নেওয়ার একটা শেষ চেষ্টা করলেন উনি। কিন্তু স্পষ্ট টের পেলেন কে যেন তাঁকে পিছন থেকে একটু ঠেলে দিল। জয়পতাকা একেবারে লাট খেয়ে-খেয়ে এক বিশাল খাদের মধ্যে হুহু করে পড়ে যেতে লাগলেন।
পড়ছেন আর ভাবছেন, এটা কি ঠিক হয়েছে? আজই যে লোকটা অমন খ্যাপা কালু ষাঁড়কে জব্দ করল তার প্রতি ভগবানের এ কি বিচার? তবে কি কিছু লোক ঠিক কথাই বলে? কালু কি তা হলে সত্যিই শিবের ষাঁড়? তার পিঠে সওয়ার হওয়া কি আমার উচিত হয়নি।
পড়তে অনেকটা সময় লাগছিল জয়পতাকাবাবুর। সেই ফাঁকে তিনি একটা হাই তুললেন এবং একবার আড়মোড়াও ভেঙে নিলেন। তারপর দ্বিতীয় হাইটা তুলতে গিয়ে একটা ধপাস শব্দ শুনলেন এবং শরীরে একটা প্রবল ঝাঁকুনি লাগল। বুঝলেন যে, তিনি পড়েছেন। তবে বেঁচে আছেন কি না বুঝতে পারছেন না, খাস অবশ্য চলছে। বুকটাও ঢিবঢিব করছে।