দৃশ্যটা ভাল হলেও জয়পতাকাবাবুর কিন্তু এতে কোনও কৃতিত্ব নেই। কারণ শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে কালুর পিঠে সওয়ার হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাঁর ছিল না। নেহাতই দৈবক্রমে তিনি কালুর পিঠের ওপর এসে পড়েন। কিন্তু লোকে তা জানে না। লোকে এও জানে না যে, কালুর তোয় জয়পতাকাবাবুর মাথায় এমনই এক সাঙ্ঘাতিক ঝাঁকুনি লাগে, যার ফলে তাঁর বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে যায় এবং তিনি স্মৃতিভ্রংশ হয়ে পড়েন।
কালু যখন তাঁকে পিঠে নিয়ে ছুটছে, তখন জয়পতাকাবাবু বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা কী হচ্ছে। তবে তিনি বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে পড়লেও স্বাভাবিক জৈব তাড়নায় ছুটন্ত কালুর পিঠ থেকে নামবার চেষ্টা করলেন না। বরং খুব আঁট হয়ে বসে রইলেন। বসে বসে তিনি চারিদিকের ছুটন্ত বাড়িঘর এবং লোকজন দেখতে লাগলেন। এটা কোন শহর তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না, যদিও এই শহরেই তাঁর জন্ম। তিনি যে কে, তাও তিনি বুঝতে পারছিলেন না। পূর্বাপর কোনও ঘটনাই তাঁর মনে পড়ল না। তিনি শুধু বুঝতে পারছিলেন যে, এক বেগবান ষাঁড়ের পিঠে তিনি বসে আছেন। ব্যাপারটা তাঁর কাছে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল। যেন তিনি রোজই ষাঁড়ের পিঠে চেপে ঘুরে বেড়ান। তাই তিনি হাসি-হাসি মুখ করেই বসে রইলেন। শুধু তাই নয়, রাস্তার দুধারে দাঁড়ানো যেসব লোক বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে দৃশ্যটা দেখছিল, তাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিনন্দনও জানাতে লাগলেন।
কালুর জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা আর হয়নি। এই শহরে সে ছিল একচ্ছত্র সম্রাট। এই অঞ্চলে আরও কয়েকটা ষাঁড় আছে বটে, কিন্তু তারা কেউ কালুর সমকক্ষ নয়। কালুকে তারা রীতিমত মান্যগণ্য করে, এমনকী নিজেদের ভাষায় হয়তো কাকা-জ্যাঠা বা ওস্তাদ কিংবা মহারাজ বলে ডাকেও। কালুকে খাতির না করেই বা কে? উঁতোর চোটে সে বহু লোককে ঢিট করেছে, স্বয়ং দারোগাবাবুকেও ছাড়েনি। এমনকী শ্যাম লাহিড়ীর খুনিয়া ডোবারম্যান কুকুরটা অবধি তাকে পথ ছেড়ে দেয়। কালুর পিঠে যখন একটা মাছিও বসবার আগে দুবার ভাবে, তখন এ লোকটা যে, কী করে উড়ে এসে জুড়ে বসল সেটাই কালুর মাথায় আসছে না। যতই ভাবছে কালু ততই এই হেনস্থা আর অপমানে আরও মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। আর আতঙ্কিত হয়ে সে ছুটছেও প্রাণপণে। আপদটাকে পিঠ থেকে না সরাতে পারলে তার শান্তি নেই।
ছুটতে ছুটতে কালু শহর পেরিয়ে এল। পথশ্রমে তার মুখ দিয়ে ফেনা উড়তে লাগল। তবু সে থামল না। সে পরিষ্কারই বুঝতে পারছে যে, শহরের অন্যান্য ষাঁড় আর তাকে আগের মতো মান্যগণ্য করছে না, লোকেরাও আর তাকে শিবের বাহন বলে কলটা-মুলোটা ভেট দেবে না। শ্যাম লাহিড়ীর ডোবারম্যান কুকুর এবার তাকে দেখলেই নিঘাত ইংরেজিতে ঘেউ ঘেউ করে দুয়ো দেবে। গায়ের জ্বালা জুড়োতে সামনে নদী দেখে কালু তাতে নেমে পড়ল।
নদীতে জল বেশি নেই। কালুর পেটটাও ভিজল না জলে। সে নদী পেরিয়ে ডাঙায় উঠল। সামনে পটাশগড়ের ভয়াবহ জঙ্গল। এই জঙ্গলে ঢুকবার আগেই বাঘের গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। তা ছাড়া আরও কত হিংস্র জানোয়ার আছে। ভালুক, চিতা, গণ্ডার, বুনো শুয়োর, বন্য কুকুর আর মোষ।
পটাশগড়ের আরও নানা বদনাম আছে। তবে কালু সেগুলো জানে না। সে বাঘের গায়ের গন্ধটা অবশ্য ভালই টের পায়। বাঘ হল পশুর জগতে গুণ্ডা বলো গুণ্ডা, মস্তান বলো মস্তান। তাই অতীতে অনেকবার ধারেকাছে এলেও কালু পটাশগড়ের জঙ্গলে ঢুকতে সাহস পায়নি। কিন্তু আজ তার মাথার ঠিক নেই। পিঠের বিচ্ছিরি বোঝাটাকে না নামালেই নয়। পটাশগড় ঘন জঙ্গল। লুতায়-পাতায়, গাছপালায় একেবারে নিচ্ছিদ্রই বলা যায়। কোনও একটা ফাঁক দিয়ে একবার জঙ্গলে ঢুকতে পারলে ডালপালায় আটকে লোকটা তার পিঠ থেকে পড়বেই।
কালু জানে না, পটাশগড়ের জঙ্গলে শুধু সে কেন, অমন বাঘা শিকারি শ্যাম লাহিড়ী অবধি একেবারের বেশি দুবার ঢোকেনি। জঙ্গলের ভিতরে ভুতুড়ে জলা, চোরাবালি, গভীর খাদ সবই আছে। আছে জোঁক, সাপ, বিছে, তা ছাড়া আর যা আছে তা
নিয়ে লোকে বেশি উচ্চবাচ্য করে না। কিন্তু জায়গাটা সবাই এড়িয়ে চলে। এমনকী কাঠুরে বা পাতাকুড়নি বা মউলিরাও বড় একটা এদিকপানে আসে না। এসব জানে না বলেই কালু তার পিঠের অনভিপ্রেত সওয়ারটিকে নিয়ে সবেগে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।
জয়পতাকাবাবুর স্মৃতিভ্রংশ হলেও জৈবিক বুদ্ধি লোপ পায়নি। তিনি ঘন ডালপালা দেখেই কালুর পিঠে সটান শুয়ে পড়লেন উপুড় হয়ে। তাতে খুব একটা লাভ হল না। সন্ধের আবছা আঁধার নেমে এসেছে বাইরে। আর জঙ্গলের ভিতরটা ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। সবেগে নানা গাছের ডাল হেডসারের বেতের মতো জয়পতাকাবাবুর পিঠে এবং হাতে-পায়ে এসে লাগছিল। তিনি উঃ-আঃ করতে লাগলেন। কালু আরও ভিতরে ঢুকে পড়তে লাগল। সপাং করে পিঠে একটা কচি বাঁশের ডগা লাগতেই জয়পতাকাবাবু ‘গেলাম’ বলে মাথাটা যেই তুলেছেন, অমনি গদাম করে একটা মোটা গাছের ডাল তাঁর কপালে এসে লাগল। জয়পতাকাবাবু মাটিতে ছিটকে পড়ে গেলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন কাছ থেকেই ভারী মোলায়েম গলায় বলে উঠল, “আসুন! আসুন! কী ভাগ্য আমাদের!”
জয়পতাকাবাবু কপালটা চেপে ধরে খানিকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন, তারপর হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, তিনি জয়পতাকাবাবু।