ওদিকে সন্ধেবেলা স্কুলেও মিটিং চলছে। জয়পতাকাবাবুর বীরত্বে ভজুরাম স্কুলের সকলেই গর্বিত। ম্যাচে তারা দু’গোলে হারা সত্ত্বেও ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব জয়পতাকাবাবুর সম্মানে আগামীকাল স্কুল ছুটি দিতে অনুরোধ করায় হেডমাস্টারমশাই ছুটি দিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মুখ শুকনো। কালু জয়পতাকাকে কোথায় নিয়ে গেল?
ঘটনার সময় মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ব্যস্তবাগীশ ব্যোমকেশবাবু শহরে ছিলেন না। নিখিল জগদীশপুর মাছধরা প্রতিযোগিতা, উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে গিয়েছিলেন ঈশানগঞ্জ গণ-শৌচাগারের উদ্বোধন করতে। শহরে ফিরে খবরটা পেয়েই একটা রিকশা নিয়ে স্কুলে এসে হাজির।
“এই যে বিষ্টুবাবু, এ সব কী শুনছি? এ তো সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড মশাই। সেই যে বাঘা যতীন হাত দিয়ে বাঘ মেরেছিলেন তারপর থেকে ইনফ্যাক্ট বাঙালির তো আর তেমন বীরত্বের রেকর্ড নেই? অ্য, কী বলেন? ইনফ্যাক্ট আমি তো ভাবছি জয়পরাজয়বাবুকে একটা নাগরিক সংবর্ধনা দেব।”
হেডসার বিষ্ণুবাবু সসম্ভ্রমে বললেন,”দেওয়াই উচিত।”
“ম্যাজিস্ট্রেটসাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি তো জয়পরাজয়বাবুর গুণগানে পঞ্চমুখ। ইনফ্যাক্ট শহরের জগগণও একই কথা বলছে। আঁ, কী বলেন? তবে, হ্যাঁ, ইনফ্যাক্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়াও যে নেই, তাও বলা যায় না। ইনফ্যাক্ট অনেকে তো খুবই চটে গেছে। তাদের বিশ্বাস, কালু হচ্ছে স্বয়ং শিবের প্রতিনিধি, তাকে জনগণের সামনে হেনস্থা করা খুবই অন্যায় হয়েছে। আর যার পিঠে চেপে স্বয়ং শিব ঘুরে বেড়ান, তার পিঠে চাপাটাও জয়পরাজয়বাবুর ঠিক হয়নি।”
বিষ্ণুবাবু সসম্ভ্রমে বললেন, “ওঁর নাম জয়পতাকা, জয়পরাজয় নয়।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ ভুল হয়েছিল। নাগরিক সংবর্ধনটা ওঁকে দেওয়াই স্থির করে ফেলি তা হলে! আঁ, কী বলেন! অবশ্য ইনফ্যাক্ট একইসঙ্গে একটা ধিক্কার সভাও হবে। অনেকে তো সমবেতভাবে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করবে, ইন ফ্যাক্ট আমাকে দুটো সভারই সভাপতি হতে হবে। আফটার অল সকলেই তো ভোটার, আমাকে সকলের দিকই দেখতে হয়।”
বিষ্ণুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা তো বটেই।”
ব্যোমকেশবাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন, “একইদিনে শহরের দু’জায়গায় জয়পরাজয়বাবুর নিন্দা এবং প্রশংসা–এ বেশ ভালই হবে। প্রশংসা করতে গিয়ে তো লোকের মাত্রাজ্ঞান থাকে না, বেশি বেশি বলে ফেলে। নিন্দা করতে গিয়েও ইনফ্যাক্ট তাই-ই হয়। এই একসেস ব্যাপারটা নিন্দা ও প্রশংসায় কাটাকাটি হয়ে যাবে। আঁ কী বলেন? তা জয়পরাজয়ঝবুকে একটু ডাকুন, আমি ওঁকে একটু অভিনন্দন জানিয়ে যাই।”
বিষ্ণুবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “কালু আর জয়পতাকা কারওই তো কোনও খোঁজ নেই।”
ব্যোমকেশবায়ু চমকে উঠে বললেন, “অ্যাঁ, সে কী!”
“সব জায়গায় ছেলেরা খুঁজে এসেছে। কালুও নেই, জয়পতাকাও নেই। জয়পতাকাকে না পেলে স্কুল চলবে কী করে ভেবে পাচ্ছি না। সে আমাদের অঙ্কের জাদুকর, গাধা পিটিয়ে মানুষ করে।”
ব্যোমকেশবাবুকে খুবই চিন্তিত দেখাল। অনেকক্ষণ ভেবে বললেন, “যদি ধরুন, ইনফ্যাক্ট জয়পরাজয়বাবুকে না-ই পাওয়া যায়, তা হলে কী করবেন?”
“আমরা অতটা ভাবছি না। জয়পতাকা যেখানেই যাক ফিরে আসবেই। ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলকে সে বড্ড ভালবাসে।”
ব্যোমকেশবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, “নাগরিক সংবর্ধনা আর ধিক্কার সভা দুটোই যে পরশুদিন। উনি না এলে তো খুবই মুশকিল, তাড়া পিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরশুদিনও যদি জয়পরাজয়বাবুর খোঁজ না-ই পাওয়া যায়, তা হলে কী করবেন?”
“আমরা অতটা ভাবছি না। জয়পতাকা যেখানেই যাক ফিরে আসবেই। ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলকে সে বড্ড ভালবাসে।”
ব্যোমকেশবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, “নাগরিক সংবর্ধনা ধিক্কারসভা দুটোই যে পরশুদিন। উনি না এলে তো খুবই মুশকিল, তাঁড়া পিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরশুদিনও যদি জয়পরাজয়বাবুর খোঁজ পাওয়া না যায় তা হলে…”
“তা হলে আমাদের মুরারীবাবুই অঙ্ক করাবেন। কিন্তু উনি বুড়ো হয়েছেন…”
ব্যোমকেশবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “পরশুদিনও জয়পরাজয়বাবু না ফিরলে আমরা নাগরিক সংবর্ধনাটাকে শোকসভা করে দেব। অ্য, কী বলেন? ধরেই নিতে হবে যে, ইনফ্যাক্ট উনি মারাই গেছেন। কিলড বাই কালু।”
সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেই ব্যোমকেশবাবু তড়িৎ-পায়ে বেরিয়ে গিয়ে রিকশায় চাপলেন। তাঁর মেলা কাজ। আজ রাতে একটা ব্রিজখেলা প্রতিযোগিতা, একটা ব্যায়াম প্রতিযোগিতা, একটা গানের জলসা উদ্বোধন করতে হবে। পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বের করে এনগেজমেন্টগুলো দেখে নিয়ে আপনমনে বললেন, “উঃ কত কাজ! সকলের মুখেই কেবল ব্যোমকেশ আর ব্যোমকেশ। ব্যোমকেশ ছাড়া কারও চলে না। হুঁ হুঁ বাবা, শ্যাম লাহিড়ীকে আর কলকে পেতে হচ্ছে না।”
২. ওদিকে জয়পতাকাবাবুর কী হল
ওদিকে জয়পতাকাবাবুর কী হল সেটাও একটু দেখা দরকার।
একথা ঠিক যে, তিনি কালুকে নিরস্ত করতে গিয়ে প্রচণ্ড সাহস ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি যে স্পেনদেশে জন্মগ্রহণ করলে একজন প্রথম শ্রেণীর বুল ফাঁইটার হতে পারতেন, সে-বিষয়েও আর সন্দেহ থাকার কথা নয়। কালুকে তিনি নিরস্ত ও পরাস্ত করেও একেবারে শেষরক্ষাটা হয়নি। লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে কালু তাঁকে ঢু মেরে শূন্যে নিক্ষেপ করে এবং তিনি শূন্যে পুরোপুরি দুটো ডিগবাজি খান। এর পরের দৃশ্য যদিও জয়পতাকাবাবুর জয়ই ঘোষণা করে। দেখা যায় তিনি কালুর পিঠে সওয়ার হয়ে বসে আছেন এবং কালু ভীত ও বিস্মিত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য ছুটছে।