বেশি খুঁজতে হল না। ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে চারজন শুয়ে আছে। জ্ঞান নেই। শক্তি নেই।
“শ্যামদাদু! শ্যামদাদু!” ভুতু জানে একমাত্র শ্যামদাদুই শক্ত লোক।
শ্যাম লাহিড়ী চোখ মেলে বলেন, “কে?”
“আমি ভুতু। উঠুন। আমি আপনাদের নিতে এসেছি।”
ব্যোমকেশ আতঙ্কিত গলায় খোনা সুরে বললেন, “ভূত! আমাদের নিতে এয়েছ! কেন বাবা?”
“ভূত নই। ভুতু।”
শ্যাম লাহিড়ী উঠে বসলেন। অতি কষ্টে! বললেন, “কী ভাবে এলি?”
“পরে বলব। উঠুন।”
ধীরে-ধীরে অবশ মৃতপ্রায় দুর্বল শরীরে সকলেই উঠে বসল। প্রাণের মায়া বড় মায়া।
ভুতু বলল, “খুব সাবধানে আমার পিছু পিছু আসুন।”
জয়ধ্বনি বললেন, “পারবি তো?”
“পারব। কিন্তু পথটা খুব সরু। একটু এদিক-ওদিক হলেই কিন্তু তলিয়ে যেতে হবে।”
উত্তর তীরচিহ্ন কোথায় তা ভুতু জানে না। কিন্তু সে জানে ঠিক বের করবে। তার আত্মবিশ্বাস প্রচণ্ড।
উত্তর দিকে কিছু দূরে এগোল ভুতু। হঠাৎ চোখে পড়ল, চোরাবালির একটা জায়গায় একটা পাথরের টুকরো পড়ে আছে। জ্যোৎস্নায় দেখা গেল সেটার গায়ে তীরের মতো কিছু আঁকা। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাথরের গায়ে খোদাই করা তীরচিহ্ন ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে। তীরটা একপাক ঘুরে বালিয়াড়ির দিকে মুখ ফেরাল। ভুতু দেখল, তার হাতঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তীরটা কাঁটায় কাঁটায় মেলানো।
“আসুন।” বলে ভুতু বালিতে পা রাখল। চোখ ঘড়ির দিকে। সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে পথটা সরে যাচ্ছে বাঁ থেকে ডাইনে। সরু পথ। প্রতি পদক্ষেপে তাকে হিসেব করতে হচ্ছে।
ব্যোমকেশ একটু পিছিয়ে পড়ায় একটা পা বালিতে গেঁথে গেল। ভুতু চেঁচিয়ে বলল, “সাবধান।”
ব্যোমকেশ প্রায় সাষ্টাঙ্গ হয়ে জয়ধ্বনির কোমর ধরে উঠে পড়ল।
“কেমন বেকুব হে! এই অবস্থায় কেউ কাউকে সাপটে ধরে?”
ঝগড়া লাগলে দুজনেরই বিপদ। পথ সরে যাচ্ছে। ভুতু বলল “সাবধান। একেবারে আমার পায়ে-পায়ে আসুন।”
সবাই নীরবে ভুতুকে অনুসরণ করতে লাগল। বাঁ থেকে ডাইনে ঘুরে কোণাকুণি ভুতু এগোতে লাগল ঘড়ি ধরে। প্রত্যেক পদক্ষেপে অঙ্ক আর জ্যামিতি মেলাতে মেলাতেও।
দশ মিনিট পর তাঁরা সবাই ভুতুর পিছু পিছু ডাঙাজমিতে উঠে এলেন।
ব্যোমকেশ পরিশ্রমে বসে পড়লেন। তারপর শুয়ে পড়ার উপক্রম করলেন।
জয়ধ্বনি শুধু বললেন, “মিটিং! মিটিং! দেরি হয়ে যাবে।”
ব্যোমকেশ সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন, “তাই তো! মিটিং আছে ভুলে গিয়েছিলাম। চলুন চলুন, দেরি করা ঠিক হবে না।”
ভুতু একবার কেল্লার দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, কেল্লা নেই। বনভূমি বিস্তার লাভ করছে। ভুতু ফিসফিস করে বলল, “তরঙ্গ পালটে গেল। হয়তো আর কোনওদিনই কেল্লাটাকে দেখা যাবে না।”
দিন-সাতেক বাদে ক্লাসে একটা শক্ত অঙ্ক দিলেন জয়পতাকা।
ভুতু অঙ্কটা কষে যখন জয়পতাকার কাছে নিয়ে গেল, জয়পতাকা ঘ্যাঁচ করে কেটে দিয়ে বললেন, “হয়নি, কেন যে অঙ্কে তুই এত কাঁচা!”
ভুতু মাথা চুলকোতে চুলকোতে জায়গায় ফিরে গেল। “নাঃ, অঙ্কই আমাকে ডোবাবে দেখছি!”