মাঝরাতে হঠাৎ ব্যোমকেশ তড়াক করে উঠে বসে বেশ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “মানুষ কী করে নরমাংস খায় আমি জানি না। কিন্তু আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে।”
একথা শুনে জয়ধ্বনি তাড়াতাড়ি লাঠি বাগিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “খবর্দার, আমার নাতির দিকে নজর দেবে না।”
ব্যোমকেশ আবার শুয়ে পড়ে বললেন, “আমি ঠাট্টা করলুম।”
“এই অবস্থায় কারও আবার ঠাট্টাও আসে নাকি? তোমার মতলব আমি বুঝেছি। যদি তেরিমেরি করো, তা হলে তিনজনে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে তোমাকে বালিতে ফেলে দেব।”
ব্যোমকেশ আর কথা বললেন না। গুনগুন করে একটু গান গাওয়ার চেষ্টা করে ব্যাপারটাকে হালকা করতে চাইলেন বোধহয়। কিন্তু সুরটা গলায় খেলাল না।
ফের ভোর হল। কিন্তু চারজনের কারওই আর উঠে বসবার মতো অবস্থা নেই। খিদের চেয়েও তেষ্টা প্রবল। শ্যাম লাহিড়ী উঠে কাঁপতে কাঁপতে ইদারার ধারে গিয়ে উঁকি দিয়ে বললেন, “বালতি আর দড়ি থাকলে ওই জলই খানিকটা খেতাম।”
ক্রমে বেলা বাড়ল। চারজন আজ আর উঠলেন না। পড়ে রইলেন মাটিতে। শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। শরীরে আর এক রত্তি জোর নেই। মাঝে মাঝে এক-একজন “জল জল” বলে কাতরে উঠছেন।
বেলা গড়াতে লাগল। বিকেল হল। ফের রাত্রি ঘনিয়ে এল।
প্রথমে জয়ধ্বনি, তারপর ব্যোমকেশ তারপর জয়পতাকা মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। শ্যাম লাহিড়ীর জ্ঞানটা লুপ্ত হল না। কিন্তু তিনিও বেশিক্ষণ লড়তে পারবেন বলে তাঁর মনে হল না।
রাত্রি গভীর হল।
.
ইকোয়েশনটা করে যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে ভুতু। শেষ আর হয় না। পাতার পর পাতা সে একটা অঙ্কই করে চলেছে। প্রতি পদক্ষেপেই নতুন নতুন মোড় ফিরছে অঙ্কটা। এসে যাচ্ছে নানা নতুন সংখ্যা, নতুন সঙ্কেত। কিন্তু ক্রমে ক্রমে বীজাকার ইকোয়েশন পরিণত হচ্ছে মহীরূপে। মস্ত মোটা প্যাডের পাতা ক্রমে-ক্রমে ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অঙ্কটা বেড়ে যাচ্ছে তত বেড়েই যাচ্ছে।
ভুতুর কোনওদিকে খেয়াল নেই। তার মাথা চমৎকার খেলছে। অঙ্কের মধ্যে ডুবে গেছে সে। একসময়ে অঙ্কটাকে সে যেন অনুভব করতে পারল, অর্থাৎ তার মনে হল, এটা শুধু অঙ্কই নয়। অঙ্ক যেন এক ব্যক্তি, তার আলাদা সত্তা আছে, শরীর আছে।
কোথা দিয়ে রাত গেল, কোথা দিয়ে দিন, তা বুঝতে পারল না ভুতু। তেষ্টা পেলেই সে শুধু বলে “জল!”
অমনি কোথা থেকে জল এসে যায়। খিদে পেলেই সে বলে, “খাবার।”
অমনি খাবার এসে যায়।
ভুতু কোনওদিকে তাকায় না। একমনে অঙ্ক কষতে থাকে। কষতে কষতে প্যাডের পাতা শেষ হয়ে এল। একদম শেষ পাতায় চলে এল ভুতু।
কিন্তু অঙ্কটা কি শেষ হবে, ভুতুর মনে হচ্ছে, আরও বহুদূর গড়াবে অঙ্কটা।
কিন্তু প্যাডের শেষ পাতাটা যেই শেষ হল, অমনি সে বুঝতে পারল, তার চারদিকে সেই ঘেরাটোপ নেমে এসেছে। তার মাথার ভিতরে কেউ বার্তা পাঠাচ্ছে।
ভুতু কলম থামিয়ে উৎকৰ্শ হল। “আমি সংখ্যা। কী চাও?”
“অঙ্কটা কি হয়েছে?”
“অঙ্কটার কোনও শেষ নেই। যত কষবে তত বড় হতে থাকবে।”
“তা হলে কী হবে? প্যাডের পাতা যে শেষ হয়ে গেল!”
“তাতে কি? অঙ্কটা প্রাণ পেয়েছে। বাকিটা সে নিজেই করবে। করে যাবে।”
“কোথায় শেষ হবে?”
“শেষ বলে কিছু নেই। হয়ে চলবে। হতে থাকবে। ঠিক এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মতো। অসীমের মতো।”
“কিন্তু আলফাবেট-সাহেব বলেছিলেন…”
“জানি। সাহেব বলেছিলেন, ইকোয়েশনটা করতে পারলে তুমি নিউমারেলসের নাগাল পাবে।”
“হ্যাঁ তাই।”
“আমি এসেছি।”
“আমি এই কেল্লার রহস্য ভাঙতে চাই।”
“পারবে না।”
“বালিতে কার পায়ের ছাপ পড়েছিল?”
“অবান্তর প্রশ্ন। এখানে যা কিছু ঘটে তার লৌকিক ব্যাখ্যা নেই। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। সে তুমি বুঝবে না।”
“জয়পতাকাবাবুর কী হবে?”
“তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি।”
, “আমি তাঁদের ফিরিয়ে নিতে চাই।”
“তাঁরা অন্য তরঙ্গে রয়েছেন। দেখা হবে না।”
“আমি তাঁদের তরঙ্গে ঢুকতে চাই।”
“তা হলে তোমারও ওই দশা হবে। তরঙ্গ বদলালে আর আমাদের সাহায্য পাবে না।”
“চোরাবালির মধ্যে পথ আছে, আমি জানি।”
“আছে। সরু পথ। সে পথ ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে যায়।”
“ঠিক ঘড়ির কাঁটার মতো?” নিউমারেলস প্রথমে জবাব দিল না। তারপর বলল, “এ্যা মিনিটের কাঁটা।”
“এখন কটা বাজে?”
“রাত বারোটা বাজতে দু’মিনিট বাকি।”
“এখন পথটা কোথায় আছে?”
“উত্তর তীরচিহ্নের বরাবর। প্রতি দশ মিনিটে ওখানে ঘুরে আসছে।”
“আমি একটা ঘড়ি চাই।”
“তুমি বুদ্ধিমান।”
“ঘড়িটা দিন।”
“ঘড়িটা তোমার কব্জিতে বাঁধা হয়ে গেছে। দ্যাখো।”
ভুতু অবাক হয়ে দেখল, বাস্তবিকই তার বাঁ হাতের কবজিতে একটা ঘড়ি। বারোটা বাজতে দেড় মিনিট বাকি।
“আমার ফ্রিকোয়েন্সি পালটে দিন।”
“দিচ্ছি। তার আগে একটা কথা।”
“কী কথা?”
“যদি তরঙ্গ না বদলাও তবে তুমি এখানে রাজার মতো থাকতে পারো। তোমার ইচ্ছা সবসময়ে পূর্ণ হবে। এত সুখ ছেড়ে যেতে চাও কেন?”
“আমি একটা অন্যায় করেছিলাম। তার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।”
“জানি। ঠিক আছে, তোমার তরঙ্গ পালটে দিচ্ছি।”
ঘরের আলোটা হঠাৎ নিভে গেল। চারদিকে একটা ঝিঁঝির মতো শব্দ। তারপরই ভুতু পড়ে গেল মাটিতে। টেবিল-চেয়ার উধাও হয়েছে।
ভুতু টের পেল, সে একটা ভাঙাচোরা গহ্বরের মধ্যে পড়ে আছে। হামাগুড়ি দিয়ে সে বেরিয়ে এল। তারপর ধীর পায়ে ঢালু বেয়ে উঠল। সামনেই অন্ধকার কেল্লার ধ্বংসস্তূপ। ভুতু কিছুক্ষণ বিষণ্ণ চোখে চেয়ে রইল।