ধ্বংসস্কৃপের এক জায়গায় চারজনই থমকে দাঁড়ালেন। সেখানে উপুড় হয়ে একটা নরকঙ্কাল পড়ে আছে। হাত-দশেক দূরে আর-একটা।
জয়ধ্বনি শ্যাম লাহিড়ীকে বললেন, “ব্যাপারটা সুবিধের বুঝছি না। সবটাই দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে।”
“দুঃস্বপ্নই। তবে জ্যান্ত দুঃস্বপ্ন।” চারদিকে ভোরের সুন্দর আলো ছড়িয়ে পড়েছে। একটু দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ বনভূমি। কিন্তু তাঁরা একটা চওড়া চোরাবালির মধ্যে কুৎসিত একটা ধ্বংসস্তূপে বন্দী।
শ্যাম লাহিড়ী হঠাৎ বললেন, “লক্ষ করেছ, পটাশগড়ে কোনও পাখিও আসে না!”
জয়ধ্বনি বললেন, “হা, জায়গাটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ।”
শ্যাম লাহিড়ী কেল্লার চারদিককার ঝোঁপ-জঙ্গল, গাছপালা লক্ষ করলেন ঘুরে-ঘুরে। চেনা গাছ খুবই কম। জলের ব্যবস্থা নেই বললেই হয়। একটা পুরনো ইদারায় অনেক নিচে জল। তাও ওপরে থিকথিক করে ময়লা ভাসছে।
ব্যোমকেশ হঠাৎ বললেন, “একটা নৌকো পেলে হত।” জয়ধ্বনি অবাক হয়ে বললেন, “নৌকো! নৌকো কেন?”
“নৌকো যখন জলে ভাসতে পারে, তখন বালিতে ভাসবে এ-আর বেশি কথা কী?”
“তা নৌকো পাবে কোথায়?”
“সেটাই ভাবছি।”
“ভাবো, কষে ভেবে ফ্যালো। মিটিং-এর এখনও ঢের দেরি।”
“আচ্ছা গাছপালা দিয়ে একটা ভেলা বানিয়ে নিলে মন্দ হয় না?”
“খুব হয়। চেষ্টা করে দ্যাখো৷”।
ব্যোমকেশ উদ্যোগী পুরুষ। সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেলেন। জয়পতাকা বিশুষ্ক মুখে তাঁকে সাহায্য করতে লাগলেন। যদিও তাঁর সন্দেহ হল, নৌকো বা ভেলা চোরাবালিতে ভাসবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু আশা জিনিসটাই ওরকম। যা অসম্ভব তাও মানুষ আশা করে।
শ্যাম লাহিড়ী আর জয়ধ্বনি একটু তফাতে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন।
জয়ধ্বনি বললেন, “দ্যাখো লাহিড়ী, বুড়ো হয়েছি। আমাদের দিন শেষ হয়ে এল। কিন্তু নাতিটা এমন বেঘোরে মরবে এটা যে সহ্য করতে পারছি না। আমার প্রাণ দিয়েও যদি ওকে বাঁচানো যায়।”
“প্রাণ তো এমনিতেও দিতে হবে, অমনিতেও দিতে হবে। কিন্তু প্রাণটা দিলেই তো আর বাঁচানো যাবে না। এখানকার গাছপালায় কোনও ফলটল দেখছি না। জল নেই। এভাবে দু-দিন বাঁচা যাবে হয়তো। তারপর ধুকতে ধুকতে মরতে হবে।”
“বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে হয়। এটা পুরনো কেল্লা, কোথাও সুড়ঙ্গ-টুড়ঙ্গও তো থাকতে পারে।
“সেকথা আমিও ভেবেছি। কিন্তু থাকলেও সেটা এতদিনে বুজে যাওয়ার কথা। তাছাড়া এই বিশাল ধ্বংসস্তূপে সরিয়ে সুড়ঙ্গ বের করাও তো অসম্ভব ব্যাপার।”
“হাল ছেড়ে দিচ্ছ? মরতে যখন হবেই, তখন চলল, চেষ্টা করে দেখি।”
“আমার আপত্তি নেই। চলো।”
দুজনেই ধ্বংসস্তৃপ, সরানোর কাজে লেগে গেলেন। কিন্তু এই পরিশ্রমে এবং রাত জাগার ফলে চারজনেরই দুপুর নাগাদ সাঙ্ঘাতিক খিদে এবং তেষ্টা পেয়ে গেল। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর ভেলা একটা ডালপালা দিয়ে তৈরি প্রায় হয়েছে বটে, কিন্তু সেটার ছিরি দেখে কারও ভরসা হল না।
জয়পতাকা বয়সে তরুণ। তাঁর খিদেও বেশি। তিনি আর কিছু না বলে গাছের কয়েকটা পাতা চিবিয়ে নিলেন। তারপর ওয়াক থুঃ বলে ফেলে দিলেন। যম তেতো। বিশ্রী গন্ধ।
সবাই মিলে আরও কয়েকটা গাছের পাতা চিবোনোর চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু সুবিধে হল না।
শ্যাম লাহিড়ী বললেন, “কেউ বেশি কথাটথা বোলো না। বেশি কথা বললে তেষ্টা পায়। জলের বন্দোবস্ত নেই। কাজেই সাবধান হতে হবে।”
ব্যোমকেশ ভেলার বাঁধা-ছাঁদা একরকম শেষ করে বললেন, “তা হলে এটাকে ভাসানো যাক এবার। জয়ধ্বনিদা সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ, উনিই আগে উঠুন।”
“কেন, আমাকে চোরাবালিতে ডুবিয়ে মেরে তোমার লাভ হবে কোন অষ্টরম্ভা? ওতে আমি উঠবার পাত্র নই। তুমি ওঠো গে।”
ব্যোমকেশ দমবার পাত্র নন। বললেন, “এবার একটা বৈঠা বা লগি দরকার। তা হলেই কেল্লা ফতে।”
লগির অভাব নেই। লম্বা একটা গাছের ডাল জোগাড় হয়ে গেল। তারপর ব্যোমকেশ ভেলাটা বালির দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে উঠে পড়লেন।
লগিটা ছিল বলে রক্ষা। কারণ, বালিতে পড়েই ভেলাটা ব্যোমকেশসহ অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যোমকেশের হাতে ধরা লগিটার ডগা শুধু উঁচু হয়ে ছিল। সেইটে চেপে ধরে শ্যাম লাহিড়ী পয়লা চোট সামলালেন। তারপর তিনজনে মিলে টেনে তুললেন ব্যোমকেশকে।
ব্যোমকেশ প্রাণে বেঁচেও কিছুক্ষণ জীবন্মাতের মতো বসে রইলেন। সর্বাঙ্গে বালি। এমন কী তাঁর দাঁতেও বালি কিচকিচ করছে, চোখে বালি কচকচ করছে। এমনকী তিনি কিছুক্ষণ মিটিং-এর কথাও ভুলে গেলেন।
ক্রমে বেলা বাড়তে লাগল। খিদে এবং তেষ্টাও বাড়তে লাগল। তারপর দেখা গেল চারজনই ঝিমোচ্ছেন।
জয়ধ্বনি হঠাৎ ঝিমোতে-ঝিমোতে সোজা হয়ে উঠে বললেন, “লাহিড়ী?”
“বলো।”
“এভাবে হার মানা কি উচিত হবে?”
“কী করতে চাও?”
“চলো। চেষ্টা করি।”
“চলো”, বলে শ্যাম লাহিড়ী উঠে পড়লেন। দুজনে আবার ধ্বংসস্তূপ সরাতে লাগলেন। কিন্তু পণ্ডশ্রম বাড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পরই দুজনই নেতিয়ে পড়লেন। হাঁফাতে লাগলেন।
বেলা গড়িয়ে বিকেল। তারপর সন্ধে। চারদিক অন্ধকার হয়ে এল।
ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর চারজন মাটিতে শুয়ে পড়লেন ক্লান্ত হয়ে। কারও মুখে কথা নেই।
ক্রমে রাত হল। রাত গভীর হল। চারজনই একটা ঘোরলাগা তন্দ্রার মধ্যে ঝিম মেরে পড়ে রইলেন। বুক ফেটে যাচ্ছে তেষ্টায়। পেট জ্বলে যাচ্ছে খিদেয়।