ভুতু সভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার এক মাস্টারমশাই…”
আবার বায়ু-তরঙ্গ এল। লোকটা যেন বলে পাঠাল, “তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। তোমার মগজের সব কথা এবং চিন্তাই আমি ধরতে পারছি।”
“আমি এখন কী করব?”
বায়ু-তরঙ্গ তার মগজে একটা ওলট-পালট ঘটিয়ে বলল, “সমাধান তোমার হাতেই আছে। বুদ্ধি খাটালেই পারবে। তোমার মগজ অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। তুমি ষড়ভুজের কম্বিনেশন বের করেছ। পারবে। চেষ্টা করো।”
“ওদের বাঁচানো যাবে?”
“চেষ্টা করো। হয়তো পারবে।”
“আপনি কী কৌশলে কথা বলছেন। এটাই কি টেলিপ্যাথি?”
“হ্যাঁ, তবে অনেক উন্নত ধরনের।”
“আপনি কোন্ গ্রহের মানুষ?”
“অনেক দূরের।”
“বালিতে কার পায়ের দাগ পড়েছিল?”
“নিউমারেলস-এর।”
“সে কে?”
“সে একটা অঙ্ক।”
“অঙ্ক। অঙ্ক কি কখনও হাঁটে। তাও জুতো পায়ে দিয়ে?”
“না, তবে অঙ্ককে শরীরী রূপ দিলে হয়।”
“তাকে কোথায় পাব?”
“কোথাও আছে। অঙ্কটা কষলেই পাবে। যেখান থেকে এসেছ, সেখানে ফিরে যাও। অঙ্ক প্রস্তুত আছে।”
আবার নীল আলোর ঝলকানি আর তীব্র শিসের শব্দ। ভুতু ফের চোখ বুজে ফেলল। যখন চোখ খুলল তখন কেউ নেই। তার মাথা ঘুরছিল। তবু সে টাইম বেরিয়ার ভেদ করে বেরিয়ে এল। তারপর ছুটতে লাগল।
যখন সেই ঘরটায় আবার ফিরে এল, তখন অবাক হয়ে দেখল, ঘরে একটা টেবিল আর চেয়ার পাতা, টেবিলের ওপর একটা প্যাড আর পেনসিল। প্যাডে দারুণ ইকোয়েশন।
ভুতু বসে পড়ল। অঙ্কটা তাকে করতেই হবে।
ওদিকে পটাশগড়ের কেল্লায় ডাইনিং হল-এ জয়পতাকা নিয়ে এসেছেন তিনজনকে। দেদার খাবার সাজানো।
জয়পতাকা বললেন, “যত খুশি খাও দাদু, এমন খাবার জীবনে খাওনি।”
জয়ধ্বনি একটু চটে উঠে বললেন, “তোর ঠাকুমার রান্নার চেয়েও ভাল? অত সোজা নয় রে। খাঁটি বিক্রমপুরের রান্না, ওর কাছে কেউ লাগে না। কচুর শাক বলো কচুর শাক, মুড়িঘণ্ট বলল মুড়িঘণ্ট, চাপড়ঘণ্ট বলো চাপড়ঘন্ট, পিঠে-পায়েস–ওসব স্বর্গীয় জিনিস।”
“খেয়েই দ্যাখো না।”
সকলেরই খিদে পেয়েছে। রাত তো কম হয়নি।
খেতে বসেই প্রথম পদটা মুখে দিয়েই জয়ধ্বনি বলে উঠলেন, “এ-হচ্ছে মাংসের সুরুয়া, বেশ বেঁধেছে।”
পরের পদটা খেতে গিয়ে ব্যোমকেশ বললেন, “এ কুমডোর ছক্কা না হয়ে যায় না। তবে খাসা হয়েছে।“
শ্যাম লাহিড়ীই শুধু বিনা মন্তব্যে খেতে লাগলেন।
মাঝপথে একটা পদ আমিষ না নিরামিষ তাই নিয়ে ব্যোমকেশ আর জয়ধ্বনিতে একটু তর্ক বেধে উঠল। জয়ধ্বনি একটা কাঁটা-চামচ বিপজ্জনকভাবে উদ্যত করে ধরায় ব্যোমকেশ মিইয়ে গেলেন।
খেয়েদেয়ে উঠে ব্যোমকেশ বললেন, “আর দেরি নয়। এবার ফেরা যাক। ওদিকে দু-দুটো মিটিং-এর মেলা কাজ বাকি। আমার এখনও বক্তৃতা মুখস্থ হয়নি।”
সকলেই সায় দিলেন।
শুধু শ্যাম লাহিড়ী বললেন, “ফেরা খুব সহজ হবে না।”
জয়পতাকা বললেন, “শক্তও কিছু নয়। আমি তো দিব্যি একটা শেয়ালের পিছু পিছু চলে এলাম। আপনারা এলেন একটা আলো ফলো করে। আমি রং ছাদে গিয়ে দূরবীনটা নামিয়ে আনি। ওটাই হচ্ছে আলোর সোর্স। তা ছাড়া আমার চটিজোড়াও হেলপ করবে।”
জয়পতাকা ছাদে উঠলেন বটে, কিন্তু দূরবীনটা খুঁজে পেলেন না। চটিজোড়াও আগের চেয়ে ভারী লাগছিল।
নিচে এসে জয়পতাকা বললেন, “দূরবীনটা নেই। এখানে খুবই অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে দেখছি। একেবারেই অবিশ্বাস্য।”
ব্যোমকেশ বললেন, “তা হলে আর দেরি নয়। দুগা বলে রওনা দেওয়া যাক।”
সকলে চোরাবালির সীমানায় এসে দাঁড়ালেন। ব্যোমকেশবাবু ধুতিটা একটু ওপরে তুলে বললেন, “তা হলে নামা যাক।”
জয়ধ্বনি বললেন, “ধুতি তুলছ কেন? জল পেরোবে নাকি?”
“তা বটে।” বলে ব্যোমকেশ ধুতি ফের নামিয়ে বললেন, “তা হলে চলুন।”
“তুমি আগে নামো।”
ব্যোমকেশ নামলেন, এবং চোখের পলকে কোমর অবধি হড়হড় করে চলে গেলেন বালির মধ্যে। শ্যাম লাহিড়ী সময়মতো
ধরলে বাকিটাও যেত।
যখন টেনে তোলা হল, তখন ব্যোমকেশ ঘড়ি দেখে বললেন, “সর্বনাশ! এ যে রাত চারটে বেজে গেল! আর কতক্ষণই বা সময় পাওয়া যাবে?”
চারজনে ভাবিত হয়ে পড়লেন। লক্ষণ ভাল নয়।
জয়পতাকা সাহস করে চটিসমেত একটা পা একটু বাড়ালেন। চোখের পলকে চটিটা পা থেকে যেন ইচ্ছে করেই খসে বালির মধ্যে তলিয়ে গেল। জয়পতাকা পিছিয়ে এলেন ভয়ে। ওই সামান্য সুযোগে দ্বিতীয় চটিটা পা থেকে একটা ব্যাঙের মতো লাফ মেরে বালিতে অদৃশ্য হল।
জয়পতাকা বললেন, “যাঃ।”
শ্যাম লাহিড়ী বিষণ্ণ গলায় বললেন, “তার চেয়ে কেল্লায় চলো। ফিরে গিয়ে ভোরের অপেক্ষা করি। দিনের বেলা যাহোক ঠিক করা যাবে।”
একথায় সকলে সায় দিয়ে কেল্লায় ফিরলেন। ডাইনিং হলের এঁটোকাঁটা সব যাদুমন্ত্রবলে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সকলে বেশ অস্বস্তি নিয়েই বসে রইলেন। একটু ঢুলুনিও এল। হঠাৎ জয়পতাকা চেঁচিয়ে উঠলেন, “এ কী!”
সবাই চমকে চেয়ে দেখল, কোথায় কেল্লা, আর কোথায় তার। সাজানো ডাইনিং হল। সব ফক্কা। তাঁরা একটা ধ্বংসস্তৃপের ওপর বসে আছেন।
বিস্ময়ে কেউ প্রথমটায় কথা বলতে পারল না। তারপর শ্যাম ১৬
লাহিড়ী ব্যস্ত গলায় বললেন, “এরকম যে হবে তা আমার জানা ছিল। এখান থেকে আজ অবধি কেউ ফিরে যায়নি। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না। চলো, উপায় একটা বের করতে হবে।”
ধ্বংসস্তূপের ইট-পাথর পার হতে বেশ কসরত করতে হল। ব্যোমকেশ ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিলেন বলে দু’বার আছাড় খেলেন।