“সাহেব তোমাদের মতো মানুষ ছিলেন না।”
“তিনি কীরকম মানুষ ছিলেন?”
“অনেক উন্নত।”
“তিনি কি অন্য কোনও গ্রহের মানুষ?”
“তিনি একটা অঘটন।” ভুতু বুঝল, এ প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যাবে না। সে তাই অন্য প্রশ্ন করল।
“তিনি কতদিন আগে মারা গেছেন?”
“চার বছর।”
“সাহেবের শরীরটার কী হল?”
“অন্য প্রশ্ন করো।”
“এই দুৰ্গটা কতদিনের?”
“দুশো বছর।”
“সাহেব কি দুশো বছর আগে এখানে ছিলেন?”
“না, এটা পটাশগড়ের এক রাজা বানিয়েছিল। দুর্গ কালক্রমে ধ্বংস হয়ে যায়। সাহেব দুর্গা দখল করে ছিলেন।”
“বুঝলাম। দুর্গে কি আমি একবার যেতে পারি?”
“তুমি ইচ্ছা করলে সবই পারো। কিন্তু দুর্গে কাউকেই পাবে না।”
“কেন? জয়পতাকাবাবু কি দুর্গে নেই?”
“আছে, একা নয়, সঙ্গে আরও তিনজন লোক আছে। কিন্তু তুমি ওদের দেখতে পাবে না।”
“কেন পাব না।”
“ওদের ফ্রিকোয়েন্সি আলাদা হয়ে গেছে। তোমার সঙ্গে মুখোমুখি হলেও তুমি ওদের দেখতে পাবে না। তোমরা পরস্পরকে ভেদ করে যাবে, কিন্তু কেউ কারও অস্তিত্ব টের পাবে না।”
“কী সর্বনাশ? এর কোনও উপায় নেই?”
“না। ওরা চিরকাল এখানেই থেকে যাবে। যদি বেরোতে চায় তা হলে চোরাবালিতে ডুবে মরবে।”
“আর আমি?”
“তোমার কথা আলাদা। তুমি ইচ্ছা করলেই ফিরে যেতে পারো। বিপদ হবে না।”
“জয়পতাকাবাবুর সঙ্গে আর কে কে আছে?”
“জয়ধ্বনি, শ্যাম লাহিড়ী আর ব্যোমকেশ।”
“সর্বনাশ! এরা যে সবাই আমার ভীষণ চেনা।”
“দুঃখিত, ওদের জন্য কিছুই করার নেই।”
“ষড়ভুজটার অর্থ কী?”
“ষষ্ঠ ইকোয়েশন। মানুষ বুঝতেই পারবে না।”
“ইকোয়েশন আমি জানি।”
“এটা কঠিন। কেউ জানে না। সাহেব জানতেন।”
“এতে কী হয়?”
“ওই ইকোয়েশনেই বিশ্ব রহস্যের, চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে, যে কষতে পারে সে দারুণ সব কাজ করতে পারে।”
“আমি কি ইকোয়েশন মিলিয়েছি?”
“না। তুমি শুধু কম্বিনেশনটা করতে পেরেছ। ওটা সোজা, তবু সবাই পারে না।”
“আমাকে কতক্ষণ আটকে রাখবেন?”
“তুমি চাইলেই ছেড়ে দেব।”
“আমি আর-একটা কথা জানতে চাই। পটাশগড়কে সকলে দেখতে পায় না কেন?”
“আমরা মাঝে-মাঝে পুরো জায়গাটারই স্পন্দন বদলে দিই। তখন দুর্গ অদৃশ্য হয়ে যায়, চোরাবালিও অদৃশ্য হয়ে যায়।”
“জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানে জঙ্গলের পশুরা কেউ ঢুকতে পারেনি, আমিও না। ওই জায়গাটায় কী ছিল?”
“টাইম বেরিয়ার বললে বুঝবে?”
“না।”
“ওই জায়গাটা তোমার সময়ে নেই। ভিন্ন সময়ে প্রোগ্রাম করা আছে।”
“তার মানে?”
“তুমি যখন জায়গাটা দেখছ, তখন ওটা বর্তমানকালে নেই। পাঁচ বছর অতীতে পিছিয়ে রয়েছে। ওর চারদিকে সময়ের বেড়া থাকায় ঢুকতে পারোনি, ঢুকতে পারলে তোমার বয়স এক মুহূর্তে পাঁচ বছর পিছিয়ে যেত।”
“ঢোকা যায় না?”
“না। লক করা আছে। টাইম বেরিয়ার আছে।”
“আমি যদি যেতে চাই।”
“কেন চাও?”
“আমি পাঁচ বছর আগে কেমন ছিলাম তা জানতে চাই।”
“সত্যিই চাও?”
“খা।”
“তুমি বুদ্ধিমান।” দেওয়াল থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল। তাতে একটা ছোট স্ফটিকের দণ্ড।
“এটা নাও। টাইম বেরিয়ারে স্পর্শ করলেই ঢুকতে পারবে।” ভুতু দণ্ডটা নিল। তারপর বলল, “এবার কী করব?”
“ইচ্ছা করো। ইচ্ছা করলেই ওই জায়গায় চলে যেতে পারবে।”
হঠাৎ সাকশনটা বন্ধ হয়ে গেল। ভুতু টের পেল, চারদিকের বলয়টা আর নেই। সে স্ফটিকের দণ্ডটা হাতে নিয়ে চোখ বুজে প্রাণপণ ইচ্ছা করল, “আমি ওখানে যাব।”
না, কোনও ম্যাজিক ঘটল না। তবে ভুতুর সমস্ত শরীরে যেন একটা বিদ্যুতের বেগ শিহরিত হয়ে বয়ে গেল। সে চলতে লাগল। সিঁড়ি বেয়ে উঠে সে সোজা চোরাবালিতে নেমে ছুটতে লাগল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে তীরগতিতে সে হাজির হয়ে গেল সেই ফাঁকা ভূমিখণ্ডের সামনে।
স্ফটিকের দণ্ডটা সামনে বাড়াতেই একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ হল। কিছু সরে গেল সামনে থেকে।
ঢুকবার আগে ভুতু ক্ষণেক দ্বিধা করল। তার বয়স পাঁচ বছর কমে যাবে? কী করে হবে সেটা? কেমন লাগবে?
খুব সাবধানে পা বাড়াল ভুতু। খুব ধীর পদক্ষেপে পা রাখল মাটিতে। তারপরেই চমকে থেমে গেল। শরীরের ওপর থেকে কিছু খসে পড়ে গেল যে। যেন একটা খোলস। মাথাটা সামান্য ধাঁধিয়ে গেল।
সামলে উঠে ভুতু দেখল, তার শরীরের দৈর্ঘ্য অনেক কমে গেছে। একটু রোগা হয়ে গেছে সে। পাঁচ বছর আগে সে কি এরকম ছিল?
ভুতু দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখতে লাগল। কিছু নেই। কিন্তু সে জানে, পাঁচ বছর আগে আলফাবেট-সাহেব বেঁচে ছিল। আর এই জায়গাটা নিশ্চয়ই কোনও কারণে সময়ের বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। খুব সম্ভব আলফাবেট-সাহেবের দেখা এখানেই পাওয়া যাবে।
ভুতু চুপ করে একটা ঝোঁপের ধারে বসে রইল। লুকিয়ে থাকাই ভাল।
খুব বেশিক্ষণ বসতে হল না ভুতুকে। আচমকা একটা নীল আলো ঝলসে উঠল আকাশে। একটা তীব্র শিসের শব্দ তার কানের পরদা প্রায় ফাটিয়ে দিতে লাগল। চারদিকে মাটি গুড়গুড় করে কাঁপছে। ভুতু বাতাসে একটা তীব্র কম্পন টের পাচ্ছিল। সে সহ্য করতে পারল না। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে মূৰ্ছিতের মতো ঢলে পড়ে গেল মাটিতে।
যখন চোখ মেলল, তখন সামনে একজন বিশাল চেহারার মানুষ দাঁড়িয়ে। প্রায় আট ফুট লম্বা, বিশাল দৈত্যের মতো আকৃতি। মানুষটা তাকে দেখছে।
ভুতু ভয়ে সিঁটিয়ে গেল।
লোকটা কথা বলল না, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় একটা বায়ু-তরঙ্গে লোকটা তার মগজে একটা প্রশ্ন পাঠিয়ে দিল, “কী চাও?”