“তা হলে ইচ্ছে প্রকাশ করতে বলছেন কেন?”
“আমার যে তাই কাজ।”
“ওই ছ’টা পাথর কিসের?”
“একটা হেক্সাগন।”
“ওটা দিয়ে কী হয়?”
“ওটা একটা কম্বিনেশন। একটা দণ্ড আছে, তা দিয়ে ছটা পাথরকে পর্যায়ক্রমে স্পর্শ করলেই দরজা খুলে যায়। তুমি অবশ্য পাথর ছুঁড়ছ।”
“তাতে কি ক্ষতি হয়েছে?”
“না। পাথরগুলো ভাঙা যায় না। অ্যাটমবোমা দিয়েও না।”
“জয়পতাকাবাবু কোথায়?”
“কেল্লায়।”
“উনি কি নিরাপদ?”
“এখন পর্যন্ত।”
“তারপর কী হবে?”
“কেউ বাঁচবে না।”
“কেন?”
“এখানে কেউ এসে বাঁচে না।”
“আমি?”
“তুমি? তোমার কথা আলাদা।”
“কেন?”
“তুমি যে কম্বিনেশনটা বের করেছ।”
“জয়পতাকাবাবু বাঁচবেন না?”
“না।”
“কিন্তু আমি যে ওঁকে উদ্ধার করতে এসেছি।”
“উনি সাহেবের কেল্লায় ঢুকেছেন। ডিনার খেয়েছেন। ওঁকে উদ্ধার করা অসম্ভব।”
“এই যে বললেন আমার সব ইচ্ছা পূর্ণ হবে।”
“হবে।”
“জয়পতাকাবাবুকে উদ্ধার করাই যে আমার ইচ্ছা।”
“ওসব নয়। তোমার নিজের সম্পর্কে ইচ্ছা কী? সেটা পূর্ণ হবে।”
“সাহেব কে?”
“আমাদের প্রভু।”
“তিনি কোথায় থাকেন?”
“তিনি নেই।”
“তার মানে?”
“তিনি বহুকাল আগে মারা গেছেন।”
“তা হলে আপনি কে?”
“আমি কেউ নই। শুধু তাঁর পুঞ্জীভূত ইচ্ছা।”
“আমি বুঝতে পারছি না। বুঝিয়ে দিন।”
“বুঝতে পারবে না। তোমার মস্তিষ্ক তত উন্নত নয়।”
“আমার মস্তিষ্কের উন্নতি কী করে হবে?”
“হবে।”
“কী করে?”
“অপেক্ষা করো।”
ভুতু পরিষ্কার টের পেল, দুটো হাত দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এল তার মাথার দুদিক দিয়ে। তারপর বাক্সের ডালা খোলার মতো তার মাথার খুলি খুলে ফেলল। সে বিন্দুমাত্র ব্যথা টের পেল না। কয়েক সেকেণ্ড শুধু মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ-চমকের মতো কিছু ঘটতে লাগল। তারপর হাত দুটো আবার দেওয়ালে ঢুকে মিলিয়ে গেল।
“এটা কী করলেন?”
“ছোট একটা অপারেশন।”
“কই আমার মস্তিষ্কের তত উন্নতি ঘটল না?”
“ঘটেছে। অপেক্ষা করো, টের পাবে।”
“কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।”
“বেশিক্ষণ নয়। তোমার ধূসর কোষ জাগ্রত হয়েছে। সমন্বয়ের অপেক্ষা। তাড়াতাড়ি করলে তুমি মারা পড়বে। তাড়াতাড়ি এসব জিনিস হয় না।”
“কেন হয় না?” “মস্তিষ্কের ক্রিয়া হঠাৎ বেড়ে গেলে তুমি তাল সামলাতে পারবে না।”
“ডিনার ব্যাপারটা কী বলবেন? আমি বাতাসে বারবার ডিনারের কথা শুনেছি।”
“ডিনার হল খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সাহেব কখনও একা ডিনার খেতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর সঙ্গী ছিল না। খুব কষ্ট হত ডিনারের সময়।”
“তারপর?”
“তারপর আমরা ডিনারের সময় লোক হাজির করতাম। কিন্তু তারা এত নিবোধ যে সাহেবের সঙ্গে সমান পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলার যোগ্য ছিল না। সাহেবের ডিনার মাটি হত।”
“তারপর? সেই লোকগুলোর কী হত?”
“এক রাত্রি তারা খুব আদর-যত্ন পেত। কিন্তু পরদিন সকালে উঠেই তারা দেখতে পেত, কেল্লার জায়গায় একটা ধ্বংসস্তূপ। চারদিকে চোরাবালি। তারা বেশিরভাগই পালাতে চেষ্টা করে চোরাবালিতে ডুবে মারা গেছে।”
“কেল্লাকে তারা ধ্বংসস্তূপ দেখত কেন?”
“ফ্রিকোয়েন্সি পালটে দেওয়া হত বলে।”
“বুঝিয়ে বলুন।”
“ফ্রিকোয়েন্সি কাকে বলে জানো?”
“কম্পন।”
“সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কম্পন। পৃথিবীর সব বস্তুরই কম্পন আছে। একটা জিনিসের ওই কম্পন বদলে দিলে সেটা অন্যরকম বা অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে। এসব উন্নত বিজ্ঞানের কথা।”
“কিন্তু আমি বুঝতে পারছি।”
“তোমার মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটেছে। কী বুঝতে পারছ?”
“একটা জিনিস দৃশ্য বা অদৃশ্য হতে পারে কিন্তু তার অস্তিত্ব মুছে যায় না। তবে তার কম্পন আমাদের কম্পনের সমানুপাতিক হলে আমরা সেটাকে বোধ করতে পারি না।”
“অনেকটা বুঝেছ। কিন্তু কী করে তা ঘটানো হয় তা জানো।”
“একটু একটু আন্দাজ করছি।”
“কী আন্দাজ?”
“সাহেব কিছু প্রাণহীন বস্তুর মধ্যে নিজের বোধ বুদ্ধি ও ইচ্ছা সঞ্চার করতে পেরেছিলেন।”
“বিশ্বজগতে প্রাণহীন কিছু নেই। সবই প্রাণময়। তবে তোমাদের বিজ্ঞান দিয়ে তা বুঝে ওঠা অসম্ভব।”
“সব বস্তুর মধ্যেই কি প্রাণ আছে?”
“আছে।”
“কিন্তু বুদ্ধি বা কর্মকুশলতা তো নেই।”
“না।”
“সাহেব সেইসব বস্তুর মধ্যে সেটা সঞ্চার করেছিলেন, তাই তো!”
“তাই। আমরা আজ্ঞাবাহী ছিলাম।”
“আপনাদের স্বাধীন ইচ্ছা কি আছে?”
“প্রোগ্রাম আছে।”
“বুঝতে পারছি। অনেকটা কম্পিউটারের মতো, কিন্তু আরও অনেক উন্নত।”
“অনেক। তুমি বুদ্ধিমান।”
“আমার লাঠিটা কে কেড়ে নিয়েছিল?”
“ইচ্ছা।”
“আমার পথ কে মুছে দিয়েছিল?”
“ইচ্ছা।”
“বালিতে কার পায়ের দাগ পড়েছিল?”
“তুমি খুব সাহসী।”
“আবার জিজ্ঞেস করছি, বালিতে কার পায়ের দাগ পড়েছিল?”
“তুমি খুব সাহসী ও বুদ্ধিমান। তোমার জিদও প্রচণ্ড।”
“কিন্তু এ-প্রশ্নটার জবাব দিচ্ছেন না কেন? বালিতে কার। পায়ের ছাপ পড়েছিল?”
কিছুক্ষণ নীরবতা।
“বলব না।”
“তা হলে বলব, আপনি জানেন না।”
কণ্ঠস্বরটা হঠাৎ যেন ভয় খেয়ে একটু কেঁপে গেল, “অন্য প্রশ্ন করো।”
“আমি এই প্রশ্নেরই জবাব চাই।”
“আমি এই প্রশ্নের জবাব দেব না। আমি তোমার আজ্ঞাবাহী নই।”
“আপনি কি রাগ করেছেন?”
“আমাদের রাগ নেই। রাগ অযৌক্তিক ব্যাপার।”
“আমার মনে হয়, বালিতে যার পায়ের ছাপ পড়েছিল আপনি তাকে ভয় পান।”
“অন্য প্রশ্ন করো।”
“আপনার সাহেবের নাম কী?”
“আলফাবেট।”
“এটা কী ধরনের নাম?”