কালু দিগভ্রান্ত হয়ে গোলপোস্ট বরাবর চলে গিয়ে থেমেছে, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের দুপায়ের খুর দিয়ে ক্রুদ্ধ ও ভয়াল ভঙ্গিতে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে, মুখে ফেনা তুলে একটা রণহুঙ্কার দিয়ে তেড়ে আসতে শুরু করেছে।
এদিকে জয়পতাকাবাবুও তৈরি। কিন্তু মুশকিল হয়েছে তাঁর পরনে মাটাভোরের পোশাক নেই। তিনি পরেছেন নিরীহ বাঙালির ঢিলেঢালা পোশাক ধুতি আর পাঞ্জাবি। পায়ের পাম্পশুটাও ষাঁড়ের লড়াইয়ের উপযুক্ত জুতো নয়। ফলে হল কি, তাঁর কাছা খুলে গেল, একপাটি জুতো হল নিরুদ্দেশ।
অকুতোভয় জয়পতাকাবাবু এক হাতে কাছা খুঁজতে খুঁজতে অন্য হাতেই লাল সালু নাড়তে নাড়তে কালুর মুখোমুখি হলেন। আশ্চর্যের বিষয়, এবারও কালু জয়পতাকা-সারকে ছুঁতে পারল না দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
চতুর্দিক থেকে সবাই কালুকে দুয়ো দিল, জয়পতাকা-সারকে জানাল অভিনন্দন।
জয়পতাকাবাবু হঠাৎ বুঝতে পারলেন, তাড়াহুড়োয় তিনি কাছাটা খুঁজেছেন পাঞ্জাবিসমেত। ফলে পাঞ্জাবি গায়ে টাইট হয়ে তাঁকে সামনে ঝুঁকতে দিচ্ছে না। একপায়ে জুতো না থাকাতে শরীরের ভারসাম্য রাখাও কঠিন হয়েছে।
কালু যখন পঞ্চমবার তাঁকে ক্রোধোন্মত্ত আক্রমণ করতে তৈরি হচ্ছে তখনও জয়পতাকাবাবু রণে ভঙ্গে দিলেন না। অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে জামাটা টেনে বের করে কাছাটা ঠিকমতো আঁটতে গেলেন।
কালু তেড়ে এল। বিভীষণ বেগেই এল। জয়পতাকাবাবু সালুটা নাড়বার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু তাড়াহুড়োয় এবার কাছার সঙ্গে সালুটা খুঁজে ফেলায় ভারী মুশকিল হল। সালুটা পিছনে গোঁজা থাকায় জয়পতাকাবাবুকে কালুর দিকে পিছন ফিরে সালুটা নাড়তে হচ্ছিল। কালু সোজা এসে গদাম করে গুঁতিয়ে দিল জয়পতাকাবাবুকে।
সবাই হায়-হায় করে উঠল। অঙ্কের এমন মাস্টার যে সাতটা শহর খুঁজলেও মিলবে না। গেল, অমন একজন মাস্টার ষাঁড়ের গুতোয় শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু দিনটা আজ কালুর নয়। আজ জয়পতাকাবাবুরই ছিল।
কালু উঁতো মারল ঠিকই, কিন্তু সঠিক ক্যালকুলেশন করে মারেনি। তোটা যদিও জয়পতাকাবাবুকে শূন্যে তুলে ফেলল, এমনকি তিনি শূন্যে দুটো সামারসল্টও খেলেন, কিন্তু কালুর শেষরক্ষা হল না। ঝড়ের বেগে গুঁতিয়ে যখন শাঁ করে কালু বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন দেখা গেল, শূন্যে ওই ডিগবাজি খেয়েও জয়পতাকা-সার নির্ভুলভাবে কালুর পিঠে সওয়ার হয়ে গেছেন। ঠিক ঘোড়সওয়ারের মতোই। তেমনি বুক ফোলানো দৃপ্ত ভঙ্গি। মেরুদণ্ড সোজা রেখে উপবিষ্ট। হাতে অবশ্য চাবুকের বদলে লাল সালু।
কালুর জীবনেও এই অভিজ্ঞতা প্রথম। এই মফস্বল শহরে সবাই তাকে দারুণ ভয় খায়। কেউ তাকে ঘাঁটায় না, মুখোমুখি লাল কাপড় দেখানো তো দূরস্থান। কিন্তু এই একটা লোক, শুধু তাকে খেপিয়েই তোলেনি, আবার নির্লজ্জের মতো পিঠের ওপরে বসেও আছে!
কালু আর ফিরল না। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কালুর মতো ভয়ঙ্কর ষাঁড়ের এরকম লেজে-গোবরে হওয়া দেখে দর্শকমণ্ডলী তুমুল হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠল। গণ্ডগোল থামলে ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব সকলকে উদ্দেশ করে গদগদ স্বরে বললেন, “পৃথিবীতে মানুষই যে শ্রেষ্ঠ জীব তা আজ আর-একবার প্রমাণিত হল। পশুশক্তি যে মানুষের কাছে চিরকালই পরাজিত হয়ে আসছে তার কারণ মানুষের প্রকৃত শক্তি হচ্ছে মনুষ্যত্ব, তার বীরত্বে। আজ সার্থকনামা জয়পতাকাবাবু মানুষের জয়পতাকাই আবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। ভীরু বাঙালি দুর্বল বাঙালির ভিতরেই লুকিয়ে আছে দুর্জয় বাঙালি। স্পেনদেশীয় বিখ্যাত মাটাডোরদের চেয়ে বাঙালি যে কোনও অংশে কম নয়, তা আবার প্রমাণিত হল। কে বলে বাঙালি হীন? বিজয়সিংহ লঙ্কা জয় করেননি? রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাননি? স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় ঝড় তোলেননি? গোষ্ঠ পাল কি সাহেবদের পা-কে রেয়াত করেছেন? সুভাষ বোস বামা ফ্রন্টে ইংরেজদের তুলোধোনা করেননি?” ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই আবেগপূর্ণ বক্তৃতায় সবাই তুমুল হাততালি ও হর্ষধ্বনি দিল। এরপর নির্বিঘ্নে খেলাও শুরু হয়ে গেল।
শুধু হেডসার শুকনো মুখে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডসারের কানে কানে বললেন, “জয়পতাকাবাবুকে কালু কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলল সেটা একটু খোঁজ করা দরকার। আপনি কয়েকটা ছেলেকে চারদিকে পাঠিয়ে দিন।”
কিন্তু মুশকিল হল, ছেলেরা সব সন্ধেবেলা ফিরে এসে হেডসারকে বলল, কালু বা জয়পতাকাবাবুকে শহরের কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে দৃশ্যটা অনেকেই দেখেছে, কালু তীরবেগে রাস্তা ধরে দৌড়ে যাচ্ছে, তার পিঠে অবিচল জয়পতাকাবাবু বসা। হাতে লাল সালু পতাকার মতো উড়ছে। দৃশ্যটা যারা দেখেছে তারাও বুঝতে পারছে না, ভুল দেখেছে কি না।
খবরটা যখন জয়পতাকাবাবুর বাড়িতে পৌঁছল তখন জয়পতাকাবাবুর দাদু জয়ধ্বনি রায় এবং বাবা জয়োল্লাস রায় হাঁ। জয়পতাকা কালুকে ঢিট করেছে এটা তাঁদের বিশ্বাসই হল না।
জয়ধ্বনি বললেন, “যদি এরকম একটা বীরের কাজ জয়পতাকা করেই থাকে, তা হলে ওকে আমি সোনার মেডেল দেব।”
জয়োল্লাসবাবুও বললেন, “আমি কাঁঠাল খেতে বড় ভালবাসি। কিন্তু কালুর ভয়ে বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে আনতে ভরসা হয় না। একদিন পাকা কাঁঠালের গন্ধ পেয়ে আমাকে এমন তাড়া করেছিল যে, আর কহতব্য নয়। কালুকে যদি জয়পতাকা দেশছাড়া করেই থাকে, তবে হরির লুট দেওয়া উচিত।”