যে জায়গায় ভুতু ডাঙায় উঠল সেটা বন্য গাছপালায় ছাওয়া এবং জমি খুব উঁচু-নিচু। এখান থেকে বাড়িটা দেখা যায় না। সামনেই একটা টিলার মতো কিছু রয়েছে।
ভুতু বসে বসে কিছুক্ষণ হাঁফ ছেড়ে নিল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
সে জানে আগেকার দিনে শত্রুর আক্রমণের ভয়ে দুর্গের চারদিকে পরিখা থাকত, থাকত ড্র ব্রিজ। এখানে পরিখার বদলে আছে চোরাবালি। এবং ড্র ব্রিজ বলতে কিছুই নেই। কিন্তু পরিবর্তনশীল একটা পথ আছে। সেই পথ কার ইচ্ছায় চলে তা বোঝবার উপায় নেই। ভুতু এও বুঝতে পারল, এখান থেকে বেরোবার কোনও উপায় নেই। পরিবর্তনশীল পথটি খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।
ভুতু মাথা ঠাণ্ডা রেখে জায়গাটা ভাল করে দেখল। সামনে টিলার ওপর একটা মস্ত বটগাছ ঝুরি নামিয়ে জায়গাটা অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক সেদিক মেলা ঝোঁপঝাড়।
ভুতু চট করে ওপরে উঠল না। সে একটু আড়ালেই থাকতে চায়। আগে বোঝা দরকার, এখানে কারবারটা কী।
স্কাউট-ছুরিটা বুদ্ধি করে পকেটে রেখেছিল ভুতু। সেটা হাতে নিয়ে সে চারদিক ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল। ঝোঁপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মেলা পাথরের চাঁই পড়ে আছে। এরকম জায়গায় পাথরের চাঁই থাকতেই পারে। কিন্তু কয়েকটা পাথরের চাঁই অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। যেন ভিতর থেকে আলো বেরোচ্ছে। সে উজ্জ্বল পাথরগুলোকে স্পর্শ করল না। বরং একটু দূর থেকে লক্ষ করল।
অনেকক্ষণ লক্ষ করার পর ভুতুর মনে হল, পাথরগুলো একটা জ্যামিতিক নকশায় সাজানো। যদি সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করা যায় তা হলে একটা ষড়বাহু-ক্ষেত্র তৈরি হবে। ভুতু এও লক্ষ করল, পাথরগুলোর রং একরকম নয়। লাল নীল সবুজ হলুদ বেগুনি আর কমলা। কিন্তু রং খুব ফিকে। ভাল করে লক্ষ না করলে বোঝা কঠিন।
ভুতু অঙ্ক বা জ্যামতিতে খুবই কাঁচা। কিন্তু সেটা তার বুদ্ধির দোষ নয়, সে পড়াশুনো করতে ভালবাসে না, তাই সবাই তাকে কাঁচা বলে জানে। কিন্তু আজ তার মনে হল, ওই উজ্জ্বল পাথরগুলোর জ্যামিতিক নকশায় একটা কোনও সঙ্কেত আছে। প্রত্যেকটা পাথর পরস্পরের চেয়ে সমান দূরত্ব রয়েছে। ভুতুর আন্দাজ এই দূরত্বে চার ফুটের মতো হবে।
ভুতু খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর যা হওয়ার হবে ভেবে নিয়ে সে গিয়ে ওই ষড়ভুজের ভিতরে ঢুকে একেবারে মধ্যবিন্দুতে দাঁড়াল।
কিছুই ঘটল না।
ভুতু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। কোনও পরিবর্তন নেই। কিছুই ঘটল না।
ভুতু সাহস করে পাথরগুলোকে নাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এক চুলও নড়াতে পারল না।
সে আবার একটু দূরে গিয়ে ষড়ভুজটাকে ভাল করে লক্ষ করল। ছটা ছ’রঙের পাথর জ্বলজ্বল করছে। কী মানে এর? কে এদের এভাবে মাটিতে সাজিয়ে রাখল? এর মধ্যে কি কোনও রহস্যের ইঙ্গিত রয়েছে?
ভুতু হতাশ হল না। কিন্তু ভাবতে লাগল।
পৃথিবীতে যা-কিছু আছে এবং যা-কিছু হয়, সবই যুক্তিপূর্ণভাবে। কোনও কিছুই অযৌক্তিক নয়। এমনকী ভূতও যদি থেকে থাকে তবে তার পিছনেও কোনও না কোনও যুক্তি এবং বিজ্ঞানও থাকবেই। ভুতু এটা বরাবর দেখেছে। সুতরাং এই ছ’টা পাথরের পিছনেও যুক্তি আছে। কিন্তু কী সে যুক্তি?
ভুতু কাছেপিঠে পড়ে-থাকা পাথরগুলোর ভিতর থেকে একটা পাথর তুলে নিল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর পাথরটা তুলে নীল রঙের পাথরটার ওপর খুব জোরে ছুঁড়ে মারল সে। সঙ্গে-সঙ্গে চড়াক করে একটা মৃদু বজ্রাঘাতের শব্দ আর খানিকটা নীলচে আলো ঠিকরে উঠল পাথরটার থেকে। আর কিছু হল না। সে আবার লাল পাথরটার গায়ে একইরকমভাবে পাথর ছুঁড়ল। একইরকম শব্দ হল তবে এবার ঠিকরে বেরোল লাল আগুনের হল্কা। একে-একে পঞ্চম পাথরটার গায়েও পাথর ছুঁড়ল সে। বাকি শুধু হলুদটা। শেষবার পাথর তুলে প্রাণপণে ছুঁড়ে মারল সে। সেই শব্দ আর সেই আগুন।
তারপরেই সে হঠাৎ দেখতে পেল, ছ’টা পাথর থেকেই ছ’রকমের আলোর রেখা বেরিয়ে পরস্পরের সঙ্গে ছ’টা বাহুর মতো লেগে গেছে। একটা অদ্ভুত সুন্দর নিখুঁত আলোর ষড়ভুজ। ভুতু মুগ্ধ হয়ে দেখল। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেল। তারপর দেখল, ষড়ভুজের মাঝখানে একটা রন্ধ্র। ভেতরে আলো জ্বলছে। একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে।
ভুতু সময় নষ্ট না করে সিঁড়ি দিয়ে নামল। বেশি দূর নয়। মাত্র কয়েক হাত। সিঁড়ির সঙ্গেই একটা মাঝারি মাপের ঘর। চারটে মসৃণ দেওয়াল। কোনও আসবাব নেই। সিঁড়ির ঠিক বিপরীত দিকের দেওয়ালে ফুট-চারেক উচ্চতায় একটা কালো বৃত্ত। অনেকটা ফুটবলের মতো বড়। ভুতু সেটার কাছে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি যেতেই সে হঠাৎ একটা চুম্বকের মতো আকর্ষণ টের পেল। কিছু যেন তাকে টানছে। প্রচণ্ড টানছে। ভুতু সামলাতে পারল না, যেন একটা স্যাকশন যন্ত্র দিয়ে টেনে ধরে রেখেছে তাকে। দেওয়ালের খুব কাছাকাছি গিয়ে সে থামতে পারল। সে বোধ করল, একটা অদৃশ্য বলয়ের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে আছে।
কারও কোনও কথা শুনতে পেল না ভুতু। কিন্তু তার মাথার মধ্যে যেন কেউ একটা সঙ্কেতবার্তা পাঠাল, “তোমার যে কোনও ইচ্ছে প্রকাশ করো, পূর্ণ হবে।”
ভুতু জবাবে বলল, “আপনি কে কথা বলছেন?”
“আমি কেউ নই।”
“আপনি কি ভূত?”
“না। আমি ইচ্ছা।”
“কার ইচ্ছা?”
“আমার নিজেরই।”
“তার মানে? আমাকে বুঝিয়ে দিন।”
“কিছু বুঝতে পারবে না।”