“দাদুভাই, তুমি কোথায়?”
“এই যে এখানে!” বলে জয়পতাকা আত্মবিস্মৃত হয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন।
উঠলেন বটে, কিন্তু নামলেন না। তাঁর বেয়াদব চটিজোড়া লাফ দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে একেবারে শূন্যে তুলে ছাদের কার্নিশ পার করে নিচের বাগানের মধ্যে নামিয়ে আনল। তবে নামাল খুব সাবধানে। ধরে।
জয়পতাকাকে দেখে জয়ধ্বনি এসে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেললেন, “বেঁচে আছিস দাদুভাই? ভাল আছিস তো?”
“ইনফ্যাক্ট বাঘের পেটে যে যাওনি বাবা, সেটাই যথেষ্ট। গেলে খুব বিপদ ছিল। কাল তোমাকে নিয়েই দু-দুটো মিটিং। স্বয়ং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন সভাপতি হয়ে।”
শ্যাম লাহিড়ীর মুখোনা খুবই গম্ভীর। তিনি চারদিকটা টর্চ ফেলে দেখবার চেষ্টা করছিলেন, তার দরকার হল না। হঠাৎ একঝাঁক উজ্জ্বল আলোয় চারদিকটা ভারী স্পষ্ট হয়ে উঠল।
জয়ধ্বনি চোখের জল মুছে বললেন, “এটা কীরকম জায়গা দাদুভাই? জঙ্গলের মধ্যে কার এমন সুন্দর বাড়ি?”
শ্যাম লাহিড়ী একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “এই সেই পটাশগড় হে জয়ধ্বনি। জায়গাটা ভাল নয়।”
“ভাল নয় মানে? দিব্যি জায়গা।”
“যা দেখছ এসব কিছুই সত্যি নয়। ভ্রান্তি মাত্র।”
“তোমার মাথা, চলো দাদুভাই, বাড়ির মালিকের সঙ্গে কেটু আলাপ করে আসি।”
জয়পতাকা ব্যাজার মুখ করে বলেন, “তার সঙ্গে আমার যে দেখাই হয়নি।”
“তা এত বড় বাড়ি দেখাশুনো করছে কে?”
“কেউ নয়।”
শ্যাম লাহিড়ী বললেন, “এখানে কেউ থাকে না জয়ধ্বনি। এটা একটা ধ্বংসস্তূপ। যা দেখছ সেটা শুধু দেখানো হচ্ছে।”
জয়ধ্বনি দার্শনিকের মতো বললেন, “ওরে বোকা, জলে যে চাঁদের ছায়া পড়ে সেটাও তো মিথ্যে, তবে ছায়াটা পড়ে কেন জানো? ওই আসল চাঁদটা আকাশে আছে বলেই।”
ব্যোমকেশককেও এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে হয়, নইলে তিনি আলোচনা থেকে বাদ পড়ে যান। তাই বললেন, “ইন ফ্যাক্ট চাঁদটা আমাদের খুবই উপকারে লাগে। জ্যোৎস্না রাতে আমরা শহরের রাস্তার আলোগুলো নিবিয়ে দিয়ে অনেক কারেন্ট বাঁচাই।”
জয়ধ্বনি কটমট করে ব্যোমকেশের দিকে চেয়ে বললেন, “যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি।”
ব্যোমকেশ জয়ধ্বনির লাঠিটার দিকে সভয়ে চেয়ে দুপা পিছিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর জয়পতাকার দিকে চেয়ে গদগদ স্বরে বললেন, “তুমি আমাদের গৌরব যে কী পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছ, তা বলে শেষ করা যায় না। সামনের বছর ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলে হুড়হুড় করে ছেলেরা ভর্তি হবে। কাল তোমাকে আমরা বিরাট করে নাগরিক সংবর্ধনা দিচ্ছি। বাঘা যতীনের পর বাঙালি আর এরকম বীরত্ব দেখাতে পারেনি। ইন ফ্যাক্ট তোমাকে আমরা বৃষবিলাসী উপাধিও দেব। বৃষবিলাসী জয়পতাকা–চমৎকার হবে। কী বলল আঁ? তবে কাজটা যে তুমি খুব ভাল করেছে এমনও বলা যায় না। শত হলেও কালু হচ্ছে শিবের বাহন। তার পিঠে চাপাটা তোমার পক্ষে একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে।
ভবিষ্যতে এব্যাপারে তোমাকে সতর্ক হতে হবে। ঘোড়ার পিঠে চাপো, মোষের পিঠে চাপো, গাধার পিঠে চড়তেও বাধা নেই। কিন্তু ষাঁড় নেভার। অনেক ধর্মপ্রাণ নরনারী ভয়ঙ্কর চটে গেছে। আমি হচ্ছি পুরপিতা, সোজা কথায় শহরের বাবা, সকলেরই বাবা। আমাকে সকলের প্রতিই পক্ষপাতশূন্য হয়ে নজর রাখতে হয়…”
জয়ধ্বনি তেড়ে এসে লাঠি উচিয়ে বললেন, “থামবে কি না?”
“যে আজ্ঞে। তবে সত্যি কথা বলতে আমি কখনও ভয় খাই না।”
“নিকুচি করেছে তোমার সত্যি কথার।” দু’জনের মধ্যে দিব্যি একটা তর্কাতর্কি বেধে গেল।
শ্যাম লাহিড়ী জয়পতাকাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, “ব্যাপারটা কী বলো তো? এ বাড়িতে কারা আছে?
“কেউ নেই।”
“তবে আলোটালো জ্বলছে কী করে?”
“অনেক ভেবেও কিছু বুঝতে পারছি না। ভিতরে এমন বন্দোবস্ত যে, মনে হয় মানুষের বসবাস আছে। কিন্তু কেউ নেই। অথচ…”।
“অথচ কী?”
“সবকিছু আপনা থেকেই হয়ে যাচ্ছে।”
“তুমি ভয় পাওনি?”
“ভয়ও পেয়েছি। আবার ভয়টা একসময়ে কেটে গেছে। আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা দেখানোর জন্যই যেন আমাকে এখানে টেনে আনা হয়েছে।”
শ্যাম লাহিড়ী চোরাবালির পরিখার দিকে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে থেকে বললেন, “ফিরে যাওয়ার পথ জানো?”
জয়পতাকা মাথা নেড়ে বললেন, “না, একটা শেয়াল আমাকে পথ দেখিয়ে এনেছিল।”
“আমরা এলাম একটা আলোকে অনুসরণ করে।”
“হ্যাঁ। ছাদ থেকে দূরবীন দিয়ে আমি সবই দেখেছি।”
শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর গলায় বললেন, “এই জায়গা সম্পর্কে আমার ধারণা ভাল নয়। তুমি যে এখানে এসেও নিরাপদে আছ দেখে নিশ্চিন্ত হচ্ছি আবার অন্য দিকে দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। আজ অবধি পটাশগড় থেকে কেউ ফেরেনি।”
“বলেন কী?”
“আমি বেশ কয়েকজনকে জানি।”
ঠিক এই সময়ে হাহা করে সেই দুষ্টু বাতাসটা বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে বয়ে এল, “কেউ ফিরবে না। কেউ ফেরবে না।”
শ্যাম লাহিড়ী স্তব্ধ হয়ে গেলেন, জয়ধ্বনি আর ব্যোমকেশের ঝগড়াও থেমে গেল। সবাই চারিদিকে তাকাতে লাগলেন।
আবার বাতাস বইল, বলল, “ফিরবার পথ নেই, ফিরবার পথ নেই।”
৬. ভুতুর মরণ-দৌড়
ভুতুর মরণ-দৌড় সফল হতে-হতেও হল না। মাত্র হাত-দশেক চোরাবালি পার হতে বাকি ছিল। ভুতু গড়াতে-গড়াতে যখন পৌঁছে যাওয়ার মুখে তখন বালির গ্রাস তার কোমর অবধি গিলে ফেলল। কিন্তু শরীরে তার বেজায় ক্ষমতা। তাই ডুবতে-ডুবতেও সে শরীরটাকে ওলট-পালট খাওয়াতে লাগল। সেই সাঙ্ঘাতিক ছটফটানি ডাঙায় সাঁতার দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার মতো। কিন্তু ভুতু তাতে আরও দু-চার হাত এগিয়ে যেতে পারল। একটা লতার মতো জিনিস বালিতে মুখ ডুবিয়ে আছে। একটু তফাতে। ভুতু প্রাণপণে নিজেকে সেদিকে ঠেলে দিতে লাগল। শরীর এবং মন একসঙ্গে একযোগে একরোখা হয়ে উঠলে তাকে ঠেকানা শক্ত। দুর্জয় চেষ্টায় বালিতে ঝড় তুলে ভুতু উপুড় হয়ে হাত বাড়িয়ে কোনওক্রমে লতাটা ধরে ফেলল। বেশ শক্ত আর মোটা একটা লতানে গাছ। সেটা প্রাণপণে চেপে ধরে নিজেকে বালির ওপর দিয়ে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে সে ডাঙায় উঠল।