দূরবীনটা খুবই শক্তিশালী তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু পৃথিবীতে যে এরকম দূরবীন আবিষ্কৃত হয়েছে সেটাই জয়পতাকার জানা ছিল না। অন্ধকারে দেখার জন্য ইনফ্রা রেড দূরবীন তৈরি হয়েছে, জয়পতাকা জানেন। কিন্তু তা দিয়ে এরকম পরিষ্কার দেখা সম্ভব নয়। অথচ এই দূরবীনটা দেখতে দাঁড়টানা জাহাজে ব্যবহৃত দূরবীনের মতো।
জঙ্গলের নানা দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ জয়পতাকার চোখে পড়ল তিনজন বুড়ো মানুষ গুঁড়ি মেরে-মেরে ঝোঁপঝাড় ভেঙে এদিকেই আসবার চেষ্টা করছে। তিনজনকেই এক লহমায় চিনে ফেললেন জয়পতাকা। একজন তাঁর দাদু জয়ধ্বনি, একজন পুরপিতা ব্যোমকেশবাবু, তৃতীয়জন শ্যাম লাহিড়ী। সবার আগে
শ্যাম লাহিড়ী, তাঁর পিছনে ব্যোমকেশ, তাঁর পিছনে জয়ধ্বনি এবং জয়ধ্বনির পিছনে একটা ডোরাকাটা বাঘ। বাঘটাকে জয়ধ্বনি দেখতে পাননি।
জয়পতাকা আতঙ্কিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “দাদু-উ।”
আশ্চর্যের বিষয় জয়ধ্বনি এই চিৎকার শুনতে পেলেন এবং চমকে উঠে বললেন, “ওই তো আমার নাতি।”
শ্যাম লাহিড়ীও শুনতে পেয়েছেন। তিনিও থমকালেন। ব্যোমকেশ একগাল হেসে বললেন, “তা হলে তো সমস্যা মিটে গেল। কালই দু-দুটো মিটিং।”
জয়পতাকা ফের চেঁচাল, “দাদু? পিছনে বাঘ?”
জয়ধ্বনি ভারী অবাক হয়ে পিছনে তাকিয়ে একেবারে বাঘটার মুখোমুখি পড়ে গেলেন। বাঘ ও জয়ধ্বনি দুজনেই একটু অপ্রস্তুত। কিন্তু বাঘটার বোধহয় ডিনার জোটেনি। প্রথমটায় লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললেও পরমুহূর্তেই সে গা ঝাড়া দিয়ে লাফানোর জন্য গুঁড়ি মারল। শ্যাম লাহিড়ী পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে ওপর দিকে একটা গুলি ছুঁড়লেন। সেই শব্দে বাঘটা বিরক্ত হয়ে একবার জয়ধ্বনিকে একটু মুখ ভেঙচে সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটে পালাল। এমনিতে বাঘ নরখাদক নয় বটে, কিন্তু আহত বা অক্ষম হলে তারা বাধ্য হয়ে সর্বভুক হয়।
বাঘ দেখে এবং পিস্তলের শব্দ শুনে ব্যোমকেশবাবু শ্যাম লাহিড়ীকে এমন চেপে ধরেছিলেন যে, আর ছাড়বার নামটি নেই।
শ্যাম লাহিড়ী বিরক্ত হয়ে বললেন, “করো কী হে ব্যোমকেশ। অমন চেপে ধরলে যে বাঘটাঘ এলে আর গুলিও চালাতে পারব না।”
ব্যোমকেশ লজ্জিত হয়ে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “না না, আপনার মতো বীর পুরুষ সঙ্গে থাকলে আর ভয় কী? তবে কিনা ইনফ্যাক্ট বাঘটা জয়ধ্বনিদাদাকে প্রায় সাবাড় করে ফেলেছিল। কী বলেন, অ্যাঁ?”
জয়ধ্বনি একটু খেচিয়ে উঠে বললেন, “তাতে তোমার ভালই হত। বাঘ আমাকেই চিবোতে থাকত, তোমরা বেঁচে যেতে।”
ব্যোমকেশ বিষণ্ণ হয়ে বললেন, “আমার মরারও জো নেই কিনা। কাল দু-দুটো মিটিং।”
“মিটিং-এর কথা যদি ফের উচ্চারণ করো তো এই লাঠি তোমার মাথায় পড়বে।”
“যে আজ্ঞে।” বলে ব্যোমকেশ চুপ করে গেলেন।
জয়ধ্বনি শ্যাম লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিন্তু আমি যে আমার নাতির গলা শুনলুম! কী হল বলো তো?”
শ্যাম লাহিড়ী বললেন, “আমিও শুনেছি।” ব্যোমকেশ বললেন, “আমিও।”
জয়পতাকা চেঁচিয়ে উঠে হাত নেড়ে বললেন, “এই যে আমি এখানে। “
জয়ধ্বনি চমকে উঠে বললেন, “ওই আবার! এই যে দাদুভাই, আমি যাচ্ছি তোমার কাছে। ভয় পেও না। চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকো।”
কিন্তু জয়পতাকা বুঝতে পারছিলেন, কাছে দেখালেও–তাঁর দাদু এবং তাঁর সঙ্গীরা এখনও অনেকটা দূরে। জলার ওধারে। কী করে যে অত দূরের কথা শোনা যাচ্ছে তা জয়পতাকা বুঝতে পারলেন না। তবে দেখলেন, তিন বুড়ো জলার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেছেন।
তিনজনেই জলার সামনে এসে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। জলে নামা এবং জলা পার হওয়া তাঁদের পক্ষে একটু শক্ত।
জয়পতাকা হঠাৎ লক্ষ করলেন, তাঁর দূরবীন থেকে হঠাৎ যেন সার্চলাইটের মতো একটা আলো ছুটে গিয়ে তিনজনের পায়ের কাছে পড়ল। দেখা গেল, জলার মধ্যে একটা সরু আলোকিত পথ ফুটে উঠেছে। আগুপিছু হয়ে অনায়াসে চলে আসা যায়।
তিনজনেই একটু স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। তারপর শ্যাম লাহিড়ী চাপা স্বরে বললেন, “জয়ধ্বনি, বলেছিলুম কিনা এই জঙ্গলে অনেক কিছু হয়!”
জয়ধ্বনি বললেন, “দেখতেই পাচ্ছি ভায়া। কিন্তু না এগিয়েও তো উপায় নেই।”
ব্যোমকেশ কথাটার সায় দিলেন, “যথার্থ বলেছেন। ইনফ্যাক্ট জয়পতাকাকে পাওয়া না গেলে কালকের দু-দুটো মিটিং-ই বরবাদ হয়ে যাবে। ইনফ্যাক্ট আমি তো সংবর্ধনার বদলে শোকসভা করব বলে একরকম ঠিক করেই ফেলেছিলাম।”
জয়ধ্বনি লাঠিটা তুলে নামিয়ে নিয়ে বললেন, “না, তোমাকে এখন মারব না। আগে জয়পতাকার সঙ্গে দেখা হোক, তারপর তোমার ব্যবস্থা।”
ব্যোমকেশ সভয়ে জয়ধ্বনির কাছ থেকে সরে এলেন এবং সকলের আগেই আলোকিত পথটি ধরে হাঁটা দিলেন।
জলা পার হতে তাঁদের তিনজনের মোটেই সময় লাগল না। তারপর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে তিজন খাদের ধারে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু খাদ তাঁদের পথ আটকাতে পারল না। আলোর রশ্মি গিয়ে সোজা পড়ল খাদের ওপরে, ওপার-এপার জুড়ে পড়ে থাকা একটা গাছের ওপরে। গাছটা কোত্থেকে এল কে জানে। তবে তিন বুড়ো খাদটা ওই গাছের ওপর দিয়ে হেঁটে পার হওয়ার পরই গাছটা আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং অন্যান্য গাছের সঙ্গে মিশে গেল। কাণ্ডটা দেখে জয়পতাকা হ করে রইলেন।
চোরাবালির ওপরেও আলোটা গিয়ে পড়ে তিন বুড়োকে পথ দেখাল। তিনজনে দিব্যি হেঁটে চোরাবালি পেরিয়ে এলেন।