তিনি বড় বড় চোখে চারদিকে চেয়ে অস্ফুট গলায় বললেন, “ভূত! ভূত! ভূত ছাড়া এসব আর কিছুই নয়। এসবই মায়া? চোখের ভুল! ভীমরতি? পাগলামি? চালাকি? ধোঁকাবাজি? জোচ্চুরি?”
আর-একটা বই তাক থেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি খুললেন জয়পতাকা। জীবজন্তুবিষয়ক বই। অনেক ছবি। কিন্তু একটাও জীবজন্তু তিনি চিনতে পারলেন না। সবচেয়ে বড় কথা, জন্তুগুলি যে-সব বনভূমিতে বিচরণ করছে, তার গাছপালাও জয়পতাকার চেনা নয়। জন্তুদের নামগুলোও অদ্ভুত বলে মনে হল তাঁর।
বইটা যখন তাঁর হাত থেকে নিয়মমাফিক কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল তখন জয়পতাকা সবলে বইটা চেপে ধরে বললেন, “দেব না! কিছুতেই দেব না!”
প্রাণপণে বইখানা বুকে আঁকড়ে দুহাতে চেপে ধরে রইলেন জয়পতাকা। কিন্তু বইটা নিজেই যেন তাঁর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য পাখির মতো ডানা ঝাঁপটাতে লাগল। ডানা বলতে আসলে দুটো মলাট। বইয়ের সঙ্গে কুস্তি করতে হবে একথা জয়পতাকা স্বপ্নেও কখনও ভাবেননি। কিন্তু সেই অমন কুস্তি আজ তাঁকে করতে হচ্ছে। প্রাণপণে চেপে ধরা সত্ত্বেও বইটা নিজেই যেন গোঁত খেয়ে একসময়ে ঠিকই বেরিয়ে গেল। আর তার ধাক্কায় মেঝের ওপর ছিটকে পড়ে গেলেন জয়পতাকা।
কোমরে বেশ ব্যথা পেয়েছেন। তবু ধীরে ধীরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। লাইব্রেরির চারদিকে অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে দেখতে লাগলেন। বই তাঁর সাঙ্ঘাতিক প্রিয় জিনিস। বিশেষ করে অঙ্ক আর বিজ্ঞানের বই। যিনি বই এত ভালবাসেন, তাঁর সঙ্গে বই কখনও কুস্তি করে? আবার ধাক্কা মেরে ফেলেও দেয়? ভারী দুঃখ হল তাঁর।
আর এই দুঃখেই তিনি লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে করিডোরে পড়লেন। পরের ঘরটা কিসের?
দরজা ঠেলতেই নিঃশব্দে খুলে গেল। বাঃ, চমৎকার শোয়ার ঘর। মস্ত খাটে নরম বিছানা পাতা। পাশে একটা টুলের ওপর সযত্নে ঢেকে রাখা এক গেলাস জল।
জয়পতাকা জলটা এক চুমুকে খেয়ে নিয়ে গেলাসটা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই গেলাসটা আবার জলে ভরে গেল, ঢাকনাটা আপনা থেকেই উঠে গেলাসটাকে ঢাকা দিয়ে দিল। জয়পতাকা আবার জলটা খেয়ে ফেললেন। আবার গেলাস জলে ভরে উঠল। ঢাকনা আপনা থেকেই ঢাকা দিল গেলাসের মুখ। তিনবারের বারও একই ঘটনা ঘটায় জয়পতাকা হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমোবেন বলে তৈরি হতে লাগলেন। জামাকাপড় সবই তাঁর কাদামাখা এবং নোংরা। লাল সালুটা এখনও কোমরে গোঁজা। শোওয়ার ঘরের লাগোয়া একটা বাথরুম রয়েছে দেখে জয়পতাকা গিয়ে ঢুকলেন। কল খুলতেই এই শীতে ভারী আরামদায়ক জল পড়তে লাগল। আর সাবানখানার যা মনমাতানো গন্ধ, তা আর বলার নয়। বেশ করে মুখ-হাত-পা ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে ঘরে আসতেই দেখলেন শুন্যে একটা পাজামা আর পাঞ্জাবি ভাসছে। জয়পতাকা জামা কাপড় পালটে নিলেন। তারপর বিছানায় শুয়ে সিলিং-এর দিকে চেয়ে রইলেন। যথেষ্ট ধকল গেছে। তাঁর তখন ঘুমনো উচিত। কিন্তু ঘুম আসছে না।
জয়পতাকা একটু এপাশ-ওপাশ করলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ঘুম তাঁর আর মোটেই আসবে না। শরীর যথেষ্ট ঝরঝরে। তাঁর মনে হচ্ছে, কোনও এক ফাঁকে তিনি অন্তত সাত-আট ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়েছেন। শরীর যথেষ্ট বিশ্রাম পেয়েছে। আর শুয়ে থাকার মানেই হয় না। কিন্তু কখন ঘুমোলেন তা তিনি মোটেই ভেবে পেলেন না। তবে তিনি বিছানা থেকে উঠে চটিজোড়া পায়ে দিয়ে বেরোতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। চটিজোড়া এল কোত্থেকে? অবশ্য ভেবে লাভ নেই। সব কিছুই তো শূন্য থেকেই আসছে। কোনও উপকারী ভূত নিশ্চয়ই। আর ভূত যদি উপকারীই হয় তবে তাকে খামোকা ভয় পাওয়ারও মানে হয় না।
কিন্তু চটিজোড়া পায়ে দিয়ে তাঁর একটু মুশকিল হল। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, তাঁর চটি দুটি একটু অবাধ্য এবং একগুঁয়ে। তিনি করিডোর দিয়ে ডান দিকে যেতে চাইছেন। কিন্তু চটি দুটি তা হতে দিল না। তাঁকে অন্য দিকে হাঁটতে বাধ্য করতে লাগল। এ বাড়ির কিছুই জয়পতাকা চেনেন না। চটি যদি তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, তো ক্ষতি কী? তিনি প্রথমে কয়েকবার চটি দুটিকে নিজের মতো চালানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন। চটি তাঁকে তাদের ইচ্ছেমতো নিয়ে যেতে লাগল। দর-দালান থেকে বেরনোর একটা দরজা খোলা রয়েছে। চটি তাঁকে সেই দরজা দিয়ে আর-একটা গলির মতো জায়গায় এনে ফেলল। গলিটা বেশ মসৃণ। একটা বাঁক খেয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে। উঠতে বিশেষ পরিশ্রম করতে হল না। জয়পতাকাকে। চটিজুতোই তাঁর পরিশ্রম ভাগাভাগি করে নিল।
একটা ভোলা ছাদে এসে তিনি একটা পুরনো আমলের লম্বা ও সরু দূরবীনের সামনে থামলেন। বলা ভাল সেখানেই তাঁকে থামানো হল। এরকম দূরবীন আগেকার দিনে জাহাজের ক্যাপ্টেনরা ব্যবহার করতেন। জয়পতাকা দূরবীনে চোখ রাখলেন। চারদিকে ম্লান জ্যোৎস্নায় ভুতুড়ে বালিয়াড়ি, তার পরে ঘন জঙ্গল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তিনি দূরবীনের ভিতর দিয়ে স্পষ্ট এবং পরিষ্কারভাবে সব দেখতে পাচ্ছেন।
এই সামান্য আলোয় গাছপালা সব কালো দেখার কথা। কিন্তু জয়পতাকা গাছের সবুজ রংও দেখতে পাচ্ছিলেন। খুঁটিনাটি অনেক কিছুই তাঁর নজরে পড়ল। একটা হনুমান বসেবসে ঘুমোতে-ঘুমোতে নিজের পেটটা খসখস করে চুলকে নিল। একটা কালো সাপ পাখির বাসায় ঢুকে পাখির ছানা গিলে ফেলল। একটা বাঘ নানা কথা ভাবতে ভাবতে একটা শিমুল গাছে গা ঘষটে নিয়ে একটা ঢেকুর তুলল।