প্রায় চল্লিশ মিনিট খাওয়ার পর বুঝলেন, তাঁর পেট খুবই আপত্তি জানাচ্ছে। হাউস ফুল। আর কিছুর ঢুকবার জায়গা নেই। জয়পতাকা একটা বড় একটা মেজো এবং ছোট ঢেকুর পর্যায়ক্রমে তুললেন। তারপর একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “না, ব্যবস্থা দেখছি ভালই। এরা খাওয়াতে জানে।”
ডাইনিং হল-এর এক কোণে ঝকঝকে বেসিন, র্যাকে ধপধপে তোয়ালে। জয়পতাকা আঁচিয়ে মুখ মুছে একটু তৃপ্তির হাসি হাসলেন। ভয়ডর কেটে গেছে। কৌতূহল বাড়ছে। বুদ্ধিও কাজ করছে।
চারদিকটা একটু সরেজমিনে দেখার জন্য তিনি ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে একটা লম্বা দর-দালানের মতো জায়গায় ঢুকে পড়লেন। ডান দিকে একটা বেশ বড় ঘর। সবুজ কার্পেট দিয়ে মোড়া ঘরখানায় উজ্জ্বল ঝাড়বাতি জ্বলছে। চারদিকে চেয়ার-টেবিল সাজানো, টেবিলে টাটকা ফুলের তোড়াওয়ালা মস্ত রুপোর ফুলদানি। ভিতর থেকে পিয়ানোর ভারী মিষ্টি আওয়াজ আসছে। জয়পতাকা ঘরে ঢুকে একটা কৌচে বসে পড়লেন। পিয়ানোর সামনে একটা টুল পাতা। তাতে কেউ বসে নেই। কিন্তু টুং-টাং করে পিয়ানো বেজে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ পিয়ানো শোনার পর তিনি জায়গাটা আরও একটু ঘুরে দেখবেন বলে দর-দালান ধরে এগোলেন। পরের ঘরটা ইনডোর গেমসের ঘর। সেখানে টেবিল টেনিস, ক্যারম, দাবার ছকের বিভিন্ন টেবিল রয়েছে।
জয়পতাকা প্রথমে টেবিল টেনিসের ব্যাট তুলে নিলেন। অমনি শুন্য থেকে একটা পিংপং বল টুক করে টেবিলে এসে পড়ল। জয়পতাকা প্রতিদ্বন্দ্বিহীন। বলটা সার্ভ করলেন আনমনে। কিন্তু চমকে উঠে দেখলেন ওপাশে ব্যাটটা শূন্যে উঠে তাঁর সার্ভটাকে স্ম্যাশ করে ফেরত পাঠাল। কে যেন বলে উঠল, “লাভ ওয়ান।”
জয়পতাকা বেকুবের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলটা কুড়িয়ে নিলেন। ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলে তিনি প্রায়ই কমনরুমে গিয়ে টেবিল টেনিস খেলেন। বেশ ভালই খেলেন।
কাজেই তাঁর জেদ চেপে গেল। ওপাশে ব্যাটটা শূন্যে ঝুলছে, দুলছে, খুব হিসেব কষে জয়পতাকা বেশ জুতসই আর-একটা সার্ভ করলেন। বলটা সঙ্গে-সঙ্গে মার খেয়ে বিদ্যুৎবেগে ফিরে এল এবং টেবিল ছুঁয়েই শাঁ করে গিয়ে দেওয়ালে লাগল।
সেই কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “লাভ টু।”
জয়পতাকা এবার খুব কোণাচে একটা চমৎকার সার্ভ পাঠালেন ওপাশে। বলটা ফিরে এল বটে, কিন্তু জয়পতাকা সেটাকে ব্লক করলেন। কিন্তু ফেরত আসা চাপটা আর আটকাতে পারলেন না।
“লাভ থ্রি।”
খেলা চলতে লাগল। তবে একতরফা। দশ মিনিটের মাথায় লাভ গেম খেয়ে জয়পতাকা বিরক্তির সঙ্গে ব্যাটটা রাখলেন। ওপাশের ব্যাটটাও টেবিলে শুয়ে পড়ল।
দাবা খেলা তাঁর খুবই প্রিয়। খুঁটি সাজানো আছে দেখে তিনি সাদা খুঁটির দিকে বসে মন্ত্রীর ঘরের বোড়েটা দুঘর এগিয়ে দিলেন। ওপাশ থেকে রাজার ঘরের বোড়ে টুক করে দুঘর এগিয়ে এল। জয়পতাকা মগ্ন হয়ে গেলেন খেলায়। প্রতিপক্ষ অতিশয় শক্ত। মাত্র বারো চাল খেলার পরই তিনি বুঝতে পারলেন, এঁটে উঠছেন না। পরের চালেই প্রতিপক্ষের কালো গজ একটা বোড়ে খেয়ে রাজার সোজাসুজি বসে গেল।
সেই স্বর বলে উঠল, “কিস্তি।”
.
দু’চাল পরে মাত হয়ে উঠে পড়লেন জয়পতাকা। ক্যারমও তিনি ভালই খেলেন। খুঁটি সাজানো আছে দেখে লোভ সামলাতে পারলেন না। কিন্তু শুরুতে স্ট্রাইক নিয়ে গোটা-তিনেক খুঁটি ফেললেও প্রতিপক্ষ একেবারেই একে-একে সব কালো খুঁটি পকেটস্থ করে দিল। তিন বোর্ডেই গেম খেয়ে জয় জয়পতাকা উঠে পড়লেন।
পরের ঘরটা লাইব্রেরি। মেঝে থেকে সিলিং অবধি চমৎকার কাঠের তাকে ঠাসা বই। কোণের দিকে একটা ইজিচেয়ার পাতা। তাতে কেউ নেই বটে, কিন্তু একখানা বই খোলা অবস্থায় শুন্যে ভেসে আছে। ঠিক যেন ইজিচেয়ারে বসে কেউ বইটা পড়ছে। জয়পতাকা ঢুকতেই বইটা ধীরে বন্ধ হয়ে গেল এবং শুন্য দিয়ে ভেসে গিয়ে একটা তাকে বইয়ের ফাঁকে ঢুকে পড়ল।
জয়পতাকা তাক থেকে একখানা বই টেনে নিয়ে খুলে পড়তে লাগলেন। এবং পড়তে পড়তে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এয়ারোডাইনামিক্সের ওপর যে এত সাঙ্ঘাতিক বই আছে তা তাঁর জানা ছিল না। কিন্তু দুটো পাতা ভাল করে পড়তে-না-পড়তেই কে যেন হাত থেকে বইখানা কেড়ে নিল। সেটা শূন্যে ভেসে ওপরের একটা তাকে গিয়ে সেঁধোল। জয়পতাকা আবার একখানা বই টেনে নিলেন। খুলে দেখলেন, সেটা মহাকাশতত্ত্বের ওপর অতি উন্নত গবেষণাধর্মী রচনা। কিন্তু এটাও দু-একপাতা পড়তে-না-পড়তেই বইটা তাঁর হস্তচ্যুত হল। কিন্তু যেটুকু পড়লেন তাতে তাঁর মাথা ঘুরে গেল। মহাকাশবিজ্ঞানের প্রায় অকল্পনীয় সব তত্ত্ব আর তথ্য রয়েছে বইটাতে। জয়পতাকা পাগলের মতো গিয়ে আর-একটা বই খুললেন। এটা শারীরবিদ্যার বই। কিন্তু যাদের শরীর নিয়ে লেখা তারা নিশ্চয়ই অতি মানুষ। বইটা হস্তচ্যুত হলে আর-একখানা বই খুলে জয়পতাকা দেখলেন, অঙ্কের বই। তবে সাধারণ অঙ্কের নয়, এই পৃথিবীর অঙ্কও নয়। এ একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরের সব অঙ্ক। যা দেখছেন জয়পতাকা তার কোনওটাই তাঁর বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। এই পৃথিবীতে বিজ্ঞান বা অঙ্ক এত উন্নতি করেনি আজও। তা হলে এই বইগুলো কে লিখল? কোথা থেকে জঙ্গলের মধ্যে এক ভুতুড়ে বাড়িতে এসে জুটল বইগুলো?
ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে গেল জয়পতাকার। হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগল উত্তেজনায়। এতক্ষণ যা কিছু ঘটেছে তাতে ভয় বা উত্তেজনার কারণ ছিল বটে, কিন্তু জয়পতাকা তা গ্রাহ্য করেননি। কিন্তু এই লাইব্রেরিতে ঢুকে যা অভিজ্ঞতা হল, তাতে তাঁর আবার মাথা গুলিয়ে গেল। মাথা গুলিয়ে গেলেই তাঁর খিদে পায়। এবং খিদে পেলেই তিনি অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা শূন্য হয়ে পড়েন।