কিন্তু ধৈর্য হারাল না সে। ওখানে যখন ধ্বংসস্তৃপ আছে, তখন পথও নিশ্চয়ই ছিল। সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
সেই হাহাকার আবার বলে গেল, “পথ নেই। পথ নেই।”
ভুতু তবু ডাণ্ডাটা দিয়ে বালিয়াড়ির বিভিন্ন জায়গায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল, পিছনে কে যেন এসে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘুরে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু যেই ৫৮
আবার খোঁচাখুঁচি শুরু করল, তখনই স্পষ্ট টের পেল, পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে লক্ষ করছে। হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস যেন পড়ল।
ভুতুর গায়ে একটু কাঁটা দিল। স্কাউট-ছুরিটা বাগিয়ে ধরে সে বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়াল, কেউ নেই। কিন্তু তবু যেন মনে হচ্ছে, কেউ আছে। সামনেই একটা মানুষ-সমান উঁচু ঝোঁপ। ভুতু এগিয়ে গিয়ে ঝোঁপটার গায়ে ডাণ্ডা দিয়ে কয়েকটা ঘা বসাল। তিন ঘা বসানোর পর চতুর্থবার লাঠিটা যেই তুলেছে, অমনি হঠাৎ তার হাত থেকে কে যেন এক মোচড়ে লাঠিটা কেড়ে নিল।
তারপর যে ঘটনা ঘটল তা চোখে দেখলেও বিশ্বাস হয় না। ভুতু দেখল, তার হাত-ছাড়া লাঠিটা শূন্যে লম্বমান হয়ে ঝুলে আছে। তারপর লাঠিটা ধীরে দুলতে দুলতে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে ভেসে-ভেসে চলে যেতে লাগল। আর লাঠিটার সঙ্গে-সঙ্গে বালির ওপর ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় পায়ের ছাপ ফুটে উঠতে লাগল।
ভুতুর গায়ে কাঁটা দিল। মাথা ঘুরে সে হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়েই যেত। অতি কষ্টে সে দাঁতে দাঁত চেপে, হাতে চিমটি কেটে নিজেকে ঠিক রাখল। দেখল লাঠিটা সেই ধ্বংসস্তূপে পৌঁছে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
স্তম্ভিতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ভুতু। মাথাটা ধোঁয়াটে, বুকটা দুরদুর করছে। হাত-পা ঠাণ্ডা।
কিন্তু গোঁয়ারগোবিন্দ ডানপিটে ভুতু সহজে হার মানে না। সে ধীরে-ধীরে বালিয়াড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে পায়ের ছাপটা পরীক্ষা করল। মস্ত বড় পা, তবে আঙুল-টাঙুলের কোনও ছাপ নেই। হয়তো অদৃশ্য একজোড়া জুতো হেঁটে গেছে। বেশ গভীর ওজনদার ছাপ।
হঠাৎ ভূতের ভয়ডর কেটে গেল। তার মনে হল, ওই ধ্বংসস্তূপে যাওয়ার পথ হয়তো এইটাই। কেউ তাকে হয়তো পথ দেখাচ্ছে। সে ভূত হলে হবে, ভুতুর তাতে আপত্তি নেই।
ভুতু প্রথম ছাপটার ওপর একটা পা রেখে দেখল, না দেবে যাচ্ছে না। সাহসে ভর করে সে ছাপটার ওপর দাঁড়াল, তারপর পরের পা রাখল পরের ছাপটার ওপর। তারপর এইভাবে ধীরে-ধীরে এগোতে লাগল। কপালে কিছু-কিছু ঘাম হচ্ছে। বুকটা দুরদুর করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। তবু শেষ অবধি দেখতে হবে। তার খুব মনে হচ্ছে, জয়পতাকাবাবু নিরুদ্দেশ হয়েছেন ওই ধ্বংসস্তৃপেই।
খুব ধীর পায়ে ভুতু এগোচ্ছিল। কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তিও বোধ করছিল সে। কেবলই মনে হচ্ছে, সামনের ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে চোরা চোখে কেউ তাকে লক্ষ করছে।
হাহাকারের শব্দে বাতাসটা আর একবার বালিতে ঝড় তুলে বয়ে গেল। বলে গেল, “ফেরার পথ নেই। ফেরার পথ নেই। ডিনার শেষ।”
ঝড়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে চোখ ঢাকল ভুতু। বালির ঝাঁপটায় তার শরীর কণ্টকিত হল। তারপর চোখ চেয়ে যা দেখল তা আতঙ্কজনক। বালির ঝড়ে সামনের ও পিছনের সব পদচিহ্ন মুছে গেছে। সে ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে।
ভুতু কী করবে তা প্রথমে বুঝতে পারল না। এক-পা এদিক-ওদিক হলেই বালিতে ডুবে মরতে হবে। কিন্তু অনন্তকাল তো দাঁড়িয়ে থাকাও যাবে না।
ভুতু স্কুলের সেরা খেলোয়াড়। সে চমৎকার দৌড়তে পারে। যদি বাকি পথটুকু সে খুব জোরে দৌড়োয়, তা হলে হয়তো চোরাবালিতে ডুববার আগেই পৌঁছে যেতে পারবে ডাঙা ৬০
জমিতে। কিন্তু মুশকিল হল, বালির ওপর জোরে দৌড়নো অসম্ভব।
ভুতুকে বিপদের ঝুঁকি নিতেই হবে। সে-জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকবার জোড়পায়ে লাফিয়ে ওয়ার্ম আপ করে নিল। তারপর একশো মিটার দৌড়ে স্টার্ট নেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়াল। বুক ভরে দম নিল। তারপর চিতাবাঘের মতো দৌড় শুরু করল। প্রতি পদক্ষেপেই তার পা ক্রমে গ্রাস করে নিচ্ছে চোরাবালি, কিন্তু ভুতু সময় নিচ্ছে না। পরের বা বাড়িয়ে পেছনের পা টেনে নিয়ে প্রায় উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। শেষ কয়েক ফুট যখন বাকি তখন সে পড়ে গেল। কিন্তু পড়েই গড়াতে শুরু করল। তারপর কী হল মনে নেই।
৫. জয়পতাকা সম্পর্কে একটা গুপ্ত খবর
জয়পতাকা সম্পর্কে একটা গুপ্ত খবর কেউ জানে না। তাঁর যখন পেটে খিদে চাগাড় দেয় তখন তিনি বোকা হয়ে যান, ভীতু। হয়ে পড়েন, কী করছেন না করছেন তা তাঁর ভাল জানা থাকে না। পেট ভরা থাকলে তাঁর মাথা ভাল কাজ করে, তখন তিনি বেশ সাহসী হয়ে ওঠেন, এবং কী করছেন না করছেন তা চমৎকার বুঝতেও পারেন। কিন্তু যেদিন তিনি মনের মতো খাবার পরম আহ্লাদ ও তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে ওঠেন, সেদিন জয়পতাকার মাথা প্রায় আইনস্টাইনের সমকক্ষ হয়ে ওঠে, তিনি প্রচণ্ড সাহসী হয়ে পড়েন এবং দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত দেখতে পান। তবে খাবারটা যতক্ষণ পেটে থাকে ততক্ষণ।
আজ দুপুরে যদি চমৎকার একটি ভোজ না খেতেন, তা হলে কি তিনি কালুর মতো দুরন্ত ও ভয়ঙ্কর ষাঁড়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারতেন দুঃসাহসে ভর করে?
আবার এই পটাশগড়ের ডাইনিং হল-এ বসে একা যখন ভোজ্যবস্তুর ঢাকনা একে-একে খুলে খেতে শুরু করলেন, তখন খাবারের স্বাদে ও গন্ধে তাঁর গান গাইতে এবং নাচতেও ইচ্ছে করছিল। এত ভাল সব খাবা তিনি জন্মেও খাননি। প্রথমেই চিনেমাটির একটা বাটির ঢাকনা খুলে দেখলেন তাতে রয়েছে আলফাবেট সুপ। সোনালি রঙের সুরুয়ার মধ্যে লাল নীল সবুজ হলুদ মেরুন রঙের এ-বি-সি-ডি, অ-আ-ক-খ সব ভাসছে। চামচ দিয়ে উষ্ণ সুপ থেকে একটা এ-তুলে মুখে দিতেই তাঁর জিভ যেন আনন্দে উলু দিয়ে উঠল। সুপটা শেষ করে তিনি স্বর্গীয় স্বাদের আরও নানা খাবার চেখে এবং খেয়ে যেতে লাগলেন। মুশকিল হল, এসব খাবার তিনি জন্মেও খাননি। এসব কী ধরনের খাবার তাও তিনি বুঝতে পারলেন না। আমিষ না নিরামিষ তাও বুঝবার কোনও উপায় নেই। কিন্তু স্বাদ অতুলনীয়। যতই খেতে লাগলেন ততই ভয় কেটে যেতে লাগল, মাথা পরিষ্কার ও বুদ্ধি ক্ষুরধার হয়ে উঠতে লাগল, এবং তাঁর কী করা উচিত এবং উচিত নয়, তা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এখন তাঁর এক নাগাড়ে খেয়ে যাওয়া উচিত। তিনি কোনওদিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে খেয়ে যেতে লাগলেন।