ভালুকটা কিন্তু সরাসরি উঠোনটা পেরোল না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফাঁকা জায়গাটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বাঁ দিকে ঘুরে টলতে টলতে ঝোঁপঝাড় ভেঙে অনেকটা ঘুরে এপাশে এসে ভুতুর কয়েক হাত দূর দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল।
ব্যাপারটা লক্ষ করে ভুতু একটু অবাক হল। সামনে বড় বড় সবুজ ঘাসে ঢাকা চমৎকার চাতালটা কেন পেরোল না ভালুক-ভায়া?
ভাবতে ভাবতেই ভুতু আর-একটা কাণ্ড দেখল, এক পাল হরিণ তাদের দিঘল পায়ে কোথা থেকে এসে তার খুব কাছেই চাতালটার সামনে থমকে দাঁড়াল, এবং তারপর অবিকল ভালুকটার মতোই সাবধানে ডান দিকে ঘুরে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ওপাশের জঙ্গলে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আর-একটু দাঁড়িয়ে থেকে ভুতু লক্ষ করল, কোনও বন্যপ্রাণীই চাতালটাকে পছন্দ করে না বা ভয় পায়। সে অন্তত দশ বারোটা শেয়ালকেও একইরকম অদ্ভুত আচরণ করতে দেখল।
চাতালটায় কী আছে? এমনিতে তো সাধারণ একটা ভোলা জায়গা বলেই মনে হয়, ভুতু চাতালটার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর সাবধানে পা বাড়াল, কিন্তু নামতে পারল না। একটা বাধা পাচ্ছে, কিসের বাধা তা সে বুঝতে পারল না। কোনও দেয়াল নেই, কাঁচ নেই, বেড়া নেই, অথচ একটা অদৃশ্য বাধা। পা বা হাত কিছুতে ঠেকছে না, অথচ চেষ্টা করেও ভুতু খোলা জায়গাটায় নামতে পারল না।
ভারী অবাক হল সে। কেন নামতে পারছে না? কেন বন্যপ্রাণীরাও জায়গাটাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? বাধাটা কিসের?
আবার একটা বাতাস হাহা করে বয়ে গেল খোলা জায়গাটা দিয়ে, “ফিরে যাও। ফিরে যাও, নইলে বিপদ।”
ভূতু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রাগে, “কিসের বিপদ? আমি বিপদকে ভয় পাই না।”
“ডিনার শেষ। ডিনার শেষ।”
“কে আপনি, সামনে এসে দাঁড়ান।” কোনও জবাব নেই।
অগত্যা ভুতু বন্যপ্রাণীদের মতোই অনেকটা ঘুরে চত্বরটা পার হল। তারপর আবার জঙ্গলে ঢুকল। তাকে চমকে দিয়েই হঠাৎ নীলচে আলোয় চারদিক ভরে গেল। ভারী মায়াবী নরম আলো। স্বপ্নের মতো। সেই আলোয় তার চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। নিবিড় অরণ্যের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল।
ভুতু টের পেল আলোর উৎস তার পিছন দিকে, ওই চত্বরে।
ভুতু চত্বরটার দিকে দৌড়ে ফিরে গেল।
কিন্তু সে যখন পৌঁছল, তখন আলো নিভে গেছে। চত্বরটা আগেকার মতোই ফাঁকা আর নির্জন। ভুতু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর আবার ঘুরে তার পথে এগোতে লাগল।
জয়পতাকা যে খাদটার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, ভুতুও সেটার মধ্যে পড়ে যেতে পারত। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে শূন্যে পা ফেলেও সে টাল সামলে নিতে পারল। আর পারল সে একজন ভাল খেলোয়াড় বলেই।
খাদের ধারে দাঁড়িয়ে ভুতু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চারদিকে তাকাল। এগোনোর আর কোনও উপায় নেই, যদি না খাদটা কোনওক্রমে পেরনো যায়।
কাছেপিঠে কোথাও একটা খ্যাপা বাঘ গর্জন করে উঠল হঠাৎ। ভুতু অত্যন্ত তড়িৎগতিতে কাছে যে-গাছটা পেল, তাতে উঠে পড়ল। অনেকটা উঁচুতে উঠে সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল। খাদের ওপার আর এপারের গাছের ডালপালা পরস্পরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। খাদটা গম্ভীর হলেও চওড়া নয়। সাহস করে এক ডাল থেকে অন্য ডালে ঝুল খেয়ে যাওয়া যায়। যে-ই কথাটা সে ভেবেছে, অমনি একটা হুতোম প্যাঁচা ‘ভুত-ভুতুম, ভুত-ভুতুম’ করে ডেকে তাকে সমর্থন জানাল।
সন্তর্পণে ভুতু একটা লম্বা ডাল বেয়ে এগোতে লাগল। ওপাশের একটা গাছের ডাল মাত্র হাত-দুয়েক দূরে নুয়ে আছে। ভুতু চোখ বুজে নিজের বিপজ্জনক অবস্থাটা খানিকটা বুঝে নিল। হাত বাড়িয়ে সে ডালটা নাগালে পাবে না। তবে এ-ডাল ছেড়ে যদি লাফিয়ে পড়ে তবে কপালজোরে ও-ডালটা ধরলেও ধরে ফেলতে পারে। কাজটা অবশ্য খুবই বিপজ্জনক। নিচে অতল খাদ হাঁ করে আছে।
ভুতু সাহস সঞ্চয় করে নিল। যা হওয়ার হবে। এ-এলাকায় সে হল গাছ বাওয়ার চ্যাম্পিয়ন। যে ডালটায় সে বসে আছে। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো, সেটা ধরে সে ঝুলে পড়ল। তারপর শরীরটাকে একটু দুলিয়ে সে নিজেকে ছুঁড়ে দিল।
বাঁ হাতটা ফসকাল। কিন্তু পড়তে পড়তেও ডান হাতে সে ডালটা পেয়ে গেল। তার ভারে ডালটা এত নুয়ে গেল যে, একবার মনে হল ভেঙে পড়ে যাবে।
ভাঙল না, নুয়ে ফের উঠে গেল ওপরে। ভুতু কিছুক্ষণ ঝুলে থেকে খুব সন্তর্পণে ডাল বেয়ে গাছের মূল শাখাপ্রশাখায় পৌঁছে গেল।
গাছ থেকে নেমে যখন সে ফের মাটির ওপর দাঁড়াল, তখন তার ঘাম হচ্ছে পরিশ্রমে। কিন্তু থামলে তো চলবে না। জয়পতাকাবাবুর যদি কিছু হয়ে থাকে তবে সে-ই তো দায়ী।
বালিয়াড়িটার কাছাকাছি এসে পৌঁছতে আরও খানিকক্ষণ সময় লাগল তার। যখন পৌঁছল তখন নিশুত রাতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় চারদিক ভারী অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
বাতাসে একটা কণ্ঠস্বর ফের হাহাকার করে উঠল, “ডিনার শেষ। ডিনার শেষ।”
ভুতু বালিয়াড়ির মাঝখানে ধ্বংসস্তৃপটার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল, “কিসের ডিনার?”
কেউ জবাব দিল না।
ভুতু বালিয়াড়ির দিকে পা বাড়াল। সে এই জঙ্গলে চোরাবালি আছে বলে শুনেছে। এই সেই চোরাবালি নয় তো? সে একটা মরা গাছের ডাল কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে দেখল, ভুশ করে ডুবে যায়। তা হলে এই সেই চোরাবালি? কিন্তু ওই ধ্বংসস্তূপের ভিতরে সব রহস্যের সমাধান আছে–এরকম মনে হচ্ছিল তার।
সে জঙ্গলের মধ্যে চারপাশটা খুঁজে একটা শক্ত আর লম্বা ডাণ্ডা জোগাড় করে ফেলল। তারপর ডাণ্ডাটা বালির মধ্যে খুঁজে কতটা গভীর তা মেপে দেখার চেষ্টা করল। ডাণ্ডাটা সম্পূর্ণই ঢুকে গেল ভিতরে, কোথাও ঠেকল না।