ভুতুর যত দোষই থাক, তাকে কেউ ভীতু বলতে পারবে না। পটাশগড়ের জঙ্গলের যত বদনামই থাক, ভুতু সেখানে প্রায়ই দুপুরবেলা যায়। ভারী নির্জন জায়গা। বুনো কুল আর বনকরমচা পাওয়া যায় শীতকালে। টক-মিষ্টি ভারী সুন্দর স্বাদ। ভুতু একা-একা ওই জঙ্গলে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে। তার অত ভয় নেই।
খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে ভুতু বুঝল যে, তার ঘুম আসবে না। মাথাটা বড্ড গরম। সে উঠে পড়ল। পাশের খাটে পিসি অঘোরে ঘুমোচ্ছ। তবে বাড়িতে বড়রা অনেকেই জেগে আছে। ঠাকুর কাজের লোক রাতে খাওয়ার পর সাফাইয়ের কাজ করছে।
ভুতু একটা সোয়েটার পরে নিল। সঙ্গে নিল স্কাউট-ছুরি। দরজা খুলে ভুতু বেরোল। তারপর চারদিক দেখে নিয়ে নিজস্ব সাইকেলটা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
পটাশগড়ে দিনের বেলা এলেও রাতে কখনওই আসেনি। কাঠের পোলের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ভুতু নদীটা পেরিয়ে পটাশগড়ের অন্ধকার, নিঝুম, ঝি-ঝি-ডাকা জঙ্গলের সামনে পৌঁছে গেল। ভয়-ভয় ভাবটা শুরু হয়ে গেল। এই অন্ধকার জঙ্গলে ঢোকা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? আর এখানে কী করেই বা খুঁজে পাবে জয়পতাকাবাবুকে?
সাইকেলটা মাটিতে শুইয়ে রেখে ক্ষণকাল মাত্র দ্বিধা করল সে। তারপর দৃঢ় পায়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে।
ঢুকতেই সে একটা হরিণের মর্মন্তুদ আর্তনাদ শুনতে পেল। সঙ্গে চাপা একটা গরগর আওয়াজ। বাঘের ডিনার শুরু হল। ভুতু স্কাউট-ছুরিটা বাগিয়ে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। এগোতে সাহস হল না। তারপর সব আবার চুপচাপ আর নিঝুম হয়ে গেল, সে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। পটাশগড়ের জঙ্গল সামনের দিকটা তেমন ঘন নয়। কিন্তু গভীর জঙ্গল ভীষণ ঘন। চলাই মুশকিল। পাতলা জঙ্গলের মধ্যে একটু জ্যোৎস্না পড়েছে। আবছা আলোয় চারদিকটা আরও গা-ছমছম করা। কিন্তু সাহস না করতে পারলে জয়পতাকাবাবুকে খুঁজে বের করা আরও কঠিন হবে।
হঠাৎ একটা টর্চের আলো তার ওপর ঝলক তুলে সরে গেল। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, “ওই একটা বাচ্চা ভূত! বাবা গো!”
চমকে উঠেও গলাটা চিনল ভুতু। ব্যোমকেশবাবু।
আর একজন গম্ভীর গলায় বলল, “ভূত যদি এত শস্তা হত, তা হলে আর ভাবনা ছিল না হে ব্যোমকেশ।”
এ-গলাটাও চেনে ভুতু। এ-হল শ্যাম লাহিড়ী।
আর-একটা লোক বলল, “যাই হোক, ব্যোমকেশ কিছু একটা দেখেছে। সেটা জয়পতাকাও হতে পারে তো! চলো দেখি।”
এ-গলা জয়ধ্বনির। ভুতু প্রমাদ গুনল। আজ যে কাণ্ড সে করেছে তা সকলেই জেনে গেছে। লোকে তার সুনাম করছে না। এখন ধরা পড়লে বিপদ আছে।
সুবিধে হল এই গহিন জঙ্গলে গা-ঢাকা দেওয়ার মতো জায়গার অভাব নেই। ভুতু নিচু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অন্যদিকে সরে যেতে লাগল। নিরাপদ দূরত্বে এসে ফের সোজা হল।
আর সোজা হয়েই সে দেখতে পেল, সামনে একটা জলা। খুব চওড়া। চাঁদের আলোয় জলটা ঝিকমিক করছে। জলার ধারে এর আগেও এসেছে ভুতু। তবে রাত্তিরে জলাটা অন্যরকম দেখাচ্ছে। যেন সত্যি নয়, যেন স্বপ্ন-স্বপ্ন।
.
এই জলায় বাঘে জল খায়। অন্য সব বন্যপ্রাণীও আসে। কাদায় তাদের গভীর পায়ের ছাপ জ্যোৎস্নাতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। এখানে গাছপালা না থাকায় চাঁদের আলো বেশ ফটফট করছে।
হঠাৎ ভুতু একটা পায়ের ছাপ লক্ষ্য করে চমকে গেল। নিচু হয়ে দেখল, মানুষের পায়ের ছাপই বটে। জয়পতাকাবাবু যদি জলায় নেমে থাকেন, তবে তো ভুতুকেও নামতেই হয়। আশায় ভরসায় ভয়টয় চলে গেল ভুতুর। জয়পতাকাবাবুর পায়ের ছাপ যখন পাওয়া গেছে, তখন জলার ওপাশে তাঁকে পাওয়া অসম্ভব নয়।
জলায় জোঁক আছে এবং ঢোঁড়া সাপ আছে। কিন্তু ভুতু সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। ঘপাস করে কাদায় নেমে পড়ল। হুপহুপ করে একটা হনুমান বড় গাছের মগডালে খানিক লাফালাফি করল। বোধহয় ভালুকটালুক দেখেছে। বাঘও দেখে থাকতে পারে। জলার ধারে ওরা তো আসবেই।
জলা পেরোতে অনেকটা সময় লাগল। ডাঙাজমিতে উঠে ভুতু তার ভেজা প্যান্ট থেকে যতটা পারে জল ঝরিয়ে নিয়ে চারদিকে চেয়ে দেখল। এবার আরও নিবিড় জঙ্গল। এদিকটায় ভুতু কখনও আসেনি। এ-পাড়ে আর পায়ের ছাপ খুঁজে পেল না সে।
ডালপালা লতা-পাতায় নিশ্চিদ্র অরণ্য। এগোনো ভারী শক্ত। পায়ের ছাপ আর খুঁজে না পেয়ে ভুতু দমে গেল বটে, কিন্তু ক্ষীণ আশা ছাড়ল না।
“সার! জয়পতাকা সার!” বলে দু’বার বেশ জোরে ডাকল আর তখনই হঠাৎ হা হা করে একটা বাতাস বয়ে গেল। সেই বাতাসে পরিষ্কার শব্দ শোনা গেল, “ডিনার শেষ। ফিরে যাও।”
ভুতু দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল। ডিনার শেষ! এর মানে কী? কে তাকে ফিরে যেতে বলছে? ভূত নাকি?
ভুতু আবার এগোতে গেল। আবার একটা পাগলাটে দমকা হাওয়া বলে গেল, “ফিরে যাও, ফিরে যাও, ডিনার শেষ।”
ফের ভুতু থমকে দাঁড়াল, একার অশরীরী কণ্ঠস্বর? এ তো বাতাসের শব্দ নয়! বাতাসের সঙ্গে কে যেন মিশিয়ে দিচ্ছে কথা। তাকে ফিরে যেতে বলছে কেন? ‘ডিনার শেষ’, একথাটার মানেই বা কী?
ভুতুর আর যাই দোষ থাক, সে ভীতু নয়। সে ডানপিটে আর একগুঁয়ে। স্কাউট-ছুরিটা খুলে নিয়ে সে শক্ত করে ধরল, তারপর এগোতে লাগল। এত দূর এসে ফিরে যাওয়ার মানেই হয় না। তা ছাড়া জয়পতাকাবাবুর খবর না নিয়ে সে ফিরবেও না।
জলার এ-পাশের জঙ্গল অনেক বেশি ঘন। গাছপালার এত জড়াজড়ি যে, পথ করে এগোনো ভীষণ শক্ত। দিক নির্ণয় করা অসম্ভব। জঙ্গলের ভিতরে ঢোকার পর চাঁদের আলো মুছে গিয়ে নিবিড় অন্ধকার। সোজা হয়ে ভুতু এগোতে পারছে না। সে কখনও চলছে গুঁড়ি মেরে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও সাপের মতো বুক ঘষটে। এইভাবে কতক্ষণ এগিয়েছে এবং কতটা, তা তার হিসেব নেই। কিন্তু হঠাৎ সে গাছপালা ভেদ করে একটা ছোট্ট খোলা জায়গায় এসে পড়ল। অনেকটা বড় একটা উঠোনের মতো জায়গা। বড় বড় ঘাস আছে, আর কিছু ঝোঁপঝাড়। সে হঠাৎ দেখতে পেল, একটা ভালুক মস্ত একটা গাছ থেকে তরতর করে নেমে এল। বোধহয় ফল বা মৌচাক ভেঙে মধু খেতে উঠেছিল। নেমে ভুতুর মতোই সে ফাঁকা জায়গাটার ওপাশে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবখানা যেন উঠোনটা পেরিয়ে সে এদিকে আসবে। ভুতু ভালুকটার মুখোমুখি পড়তে চায় না বলে দাঁড়িয়ে রইল। আর জ্যোৎস্নায় ভালুকটার গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল।