ভুতু ঘোষবাড়ির ছেলে বটে তবে তার নিজের মা বাবা নেই। ঘোষবাড়ির বড় সংসার। সকলেই লেখাপড়ায় ভাল, ভুতুর কাকা-জ্যাঠারা রীতিমত কৃতী মানুষ। কিন্তু সেই বাড়ির ছেলে হয়ে ভুতু বছর বছর পরীক্ষায় গাঁজা খায়। এক বিধবা পিসির কাছেই ভুতু মানুষ। সবাই বলে, পিসির লাই পেয়ে পেয়ে ভুতুর আজ এই দশা। দুষ্টুমির জন্য কুখ্যাতি তো তার আছেই। ফলে বাড়ির কেউ ভুতুকে সুনজরে দেখে না। ভুতু মারপিট করে বেড়ায়, গাছ বায়, ক্লাস পালিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মেশে। গুণের মধ্যে, সে খেলাধুলোয় বেশ ভাল। প্রাইজটাইজ মেলাই পায়।
কাণ্ডখানা করে সে বেশ খুশি ছিল। কালুকে খেলার মাঠে লেলিয়ে দেওয়ায় খেলা তো কিছুক্ষণের জন্য পণ্ড হয়েছেই, তার ওপর টিমে ভুতু না থাকায় স্কুল গো-হারা হেরেছে।
ভুতু সন্ধের পর বই খুলে পড়ার ঘরে বসে বসে কাণ্ডখানা ভাবছিল আর ফিচিক-ফিচিক হাসছিল।
এমন সময় মেজো জ্যাঠামশাই ডেকে পাঠালেন। ভীষণ রাগী লোক। রাশভারীও বটে।
জ্যাঠামশাই অত্যন্ত গম্ভীরভাবে কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাদের বিদেয় করে দিয়ে ভুতুর দিকে তাকিয়ে জলদগম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি আজ যা করেছ তার জন্য কোনও শাস্তিই তোমার পক্ষে যথেষ্ট নয়।”
ভুতু একটু অবাক হল, ভয়ও পেল।
জ্যাঠামশাই বললেন, “তুমিই সেই কালপ্রিট, যে কালুকে খেপিয়ে নিয়ে খেলার মাঠে ছেড়ে দিয়েছিলে। অনেকেই সেটা স্বচক্ষে দেখেছে। তোমার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের ফলে তোমাদের মাস্টারমশাই জয়পতাকার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে, কালু তাঁকে নিয়ে গিয়ে পটাশগড়ের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসেছে। ওই জঙ্গল খুবই বিপজ্জনক জায়গা। তাঁর প্রাণ যাওয়াও বিচিত্র নয়। তার ওপর কালু তাঁকে কোন্ অবস্থায় ফেলে দিয়ে এসেছে তাও আমরা বুঝতে পারছি না।”
ভুতু অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় বলল, “জয়পতাকাসার যে ওরকম কাণ্ড করবেন তা আমি জানতাম না।”
“কিন্তু এ তো জানতে যে কালুকে ওই ভিড়ের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার ফলে বহু লোকের চোট হতে পারত!”
“আজ্ঞে, আমার ভুল হয়েছে।”
“ওটুকু বললেই যথেষ্ট বলা হল না। তুমি যেমন লোকের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিলে, জয়পতাকাবাবু তেমনই লোকের উপকার করার জন্য বীরের মতোই এগিয়ে গিয়েছিলেন। সারা শহরে এখন তাঁর গুণগান হচ্ছে। আর তোমার নামে লোকে ধিক্কার দিচ্ছে। ছিঃ ছিঃ। তোমার জন্য কাল থেকে আমাদের মুখ দেখানোর জো নেই।”
খবর পেয়ে পিসি ছুটে এল। বলল, “ও ভাই গোবর্ধন, আমার ভুতু কি আর অত ভেবেচিন্তে কিছু করেছে? ছেলেমানুষ, একটা দুষ্টুমি করে ফেলেছে। ওকে ছেড়ে দে।”
গোবর্ধনাবাবু অতিশয় গম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমার জন্যই তো ওকে মানুষ করা গেল না মেজদি। তোমার ভয়ে ওকে শাসন করা আমরা একরকম ছেড়েই দিয়েছি। ফলে কী হয়েছে জানো? স্পেয়ার দি কেন অ্যান্ড স্পয়েল দা চাই।”
পিসি এক গাল হেসে বলল, “আমিও তো সেই কথাই বলি। এসপার দিয়ে কেন, ওসপার দিয়ে চলো। তা কি আর ও শোনে?”
জ্যাঠা গম্ভীরতর হয়ে বললেন, “তাই বললুম বুঝি?”
“তাই বললি না নিজে কানে শুনলুম যে। তবে তুই ইংরেজিতে বললি আমি বাংলা করে নিলুম।”
জ্যাঠামশাই খুব হতাশ হয়ে ভুতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “জয়পতাকার জন্য একটা দায়িত্ব আমাদের আছে। বিশেষ করে যখন তুমিই এ ব্যাপারটার মূলে আছ। শুনলুম, আগামীকাল ব্যোমকেশবাবু জয়পতাকার একটা সংবর্ধনাসভা করবেন বলে ঠিক করেছেন। কিন্তু জয়পতাকাকে খুঁজে পাওয়া না গেলে ওটাকে উনি কনডোলেন্স মিটিং বলেও ঘোষণা করতে পারেন। ব্যাপারটা কতদূর গড়িয়েছে দেখেছ?”
“যে আজ্ঞে।”
“আর এই সবকিছুর মূলেই তুমি। পটাশগড়ের জঙ্গল যদি ভয়াবহ জায়গা না হত, তা হলে আমি তোমাকে সেখানে পাঠাতুম। কিন্তু সেটা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হবে। জেনেশুনে তোমাকে বাঘ-ভালুকের সামনে ঠেলে দিতে পারি
। তা ছাড়া ওটা রহস্যময় জায়গাও বটে। রাতবিরেতে অত্যন্ত মিস্টিরিয়াস আলো দেখা যায়। আমি নিজেও দেখেছি দূর থেকে। সুতরাং ভেবে পাচ্ছি না কী করা উচিত।”
পিসি সঙ্গে-সঙ্গে বলে ওঠেন, “মিষ্টি কী রে? পটাশগড় বড় তেতো জায়গা। বাঘ-ভালুক ভূত-প্রেত রাক্ষস-খোক্কস ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমী গোরিলা-সিংহ জিন-পরী সব আছে। সন্ধের পর ও জায়গার নামও উচ্চারণ করতে নেই। রাম রাম রাম রাম।”
“দ্যাখো দিদি, তুমি তো রাম নাম করে বেঁচে গেলে, কিন্তু ওদিকে জয়পতাকার কী হবে তা ভেবে দেখেছ?”
“ও আর ভাবব কী? জয়পতাকাই কি কাজটা ভাল করেছে?
কালু হল শিবের ষাঁড়। স্বয়ং মহাদেব যে-পিঠে চাপেন, সেখানে বসাটাও কি আম্পদ্ধা নয়? তা যার যেমন কর্ম তেমনই তো ফল হবে। শিবরাত্তিরে কালুকে কত লোক ভোগ দেয় জানিস? কত টাকাপয়সা ছুঁড়ে দেয় কালুর পায়ে? বৈতরণী পার হতে গেলে কালুর লেজ ছাড়া আমাদের গতি আছে? সেই কালুর পিঠে জয়পতাকা কোন সাহসে চাপে শুনি!”
গোবর্ধন আর কথা বাড়ালেন না। বাড়িয়ে লাভও নেই। তিনি ভুতুর দিকে চেয়ে বললেন, “নিজের অন্যায়টা বুঝবার চেষ্টা করো গে। আর জয়পতাকা যদি প্রাণ নিয়ে ফেরে, তবে তার কাছে গিয়ে একবার ক্ষমা চেও।”
ভুতু যখন রাত সাড়ে আটটা নাগাদ খেয়ে বিছানায় গেল তখন তার মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। চোখ দুটো ভারী-ভারী লাগছে, বুকটা ভার ঠেকছে। জয়পতাকাবাবুর কাছে ক্ষমা চাইতে সে রাজি। কিন্তু ক্ষমা করার জন্য জয়পতাকা যে ফিরবেন তার ঠিক কি?