বিষ্ণুবাবু উঠতে উঠতে বললেন, “আমাদেরও যেতে হবে কি?”
শ্যাম লাহিড়ী মাথা নেড়ে বললেন, “অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট, আপনি বরং যাদের পটাশগড়ে পাঠিয়েছেন তাদের ডেকে আনার ব্যবস্থা করুন। যদি তাকে গড়-ভুতুয়াই ধরে থাকে, তবে বেশি লোক গিয়ে লাভ নেই।”
“মোটে আপনারা তিনজন যাবেন?”
“তাই যথেষ্ট। আর কাউকে যেতে হবে না।”
জয়ধ্বনি বলে উঠলেন, “তা হলে ব্যোমকেশকেই বা নিচ্ছ কেন?”
“তাকে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। লোকটা হিংসে করে। তার ওপর লোকটা বেজায় ভীতু। পেটে বিদ্যে নেই, কেবল বক্তৃতার জোরে টিকে আছে। বক্তৃতার জোরেই পৌরপিতা হয়েছে। সত্যিকারের কাজ কিছু করেনি। আহাম্মকটাকে দিয়ে কিছু করাতে হবে।”
এই বলে শ্যাম লাহিড়ী উঠে তৈরি হতে গেলেন। ভিতরের ঘরে পোশাক পালটাতে এসেই কিন্তু শ্যাম লাহিড়ীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি ভালই জানেন, জয়পতাকাকে যদি গড়-ভুতুয়া ধরে থাকে তা হলে পটাশগড়ের জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজলেও লাভ নেই। পটাশের ওই অদ্ভুত কেল্লায় কেউ এমনিতে পৌঁছতে পারে না। গড়-ভুতুয়া যদি পথ চিনিয়ে না নিয়ে যায়, তা হলে পরিশ্রমই সার হবে। তা বলে ঘরে হাত-পা গুটিয়ে থাকাও চলে না। তাঁর বন্ধু জয়ধ্বনিকে এখন ব্যস্ত রাখা দরকার। নইলে নাতির চিন্তায় লোকটার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে।
বাইরে বেরোবার পোশাক পরে পকেটে একটা ছয়ঘরা রিভলবার ভরে নিলেন শ্যাম লাহিড়ী। হাতে টর্চ আর নাল পরানো লাঠি। দুশ্চিন্তায় তাঁর বুকটা শুকিয়ে আছে। জয়পতাকাকে তিনি কোলেপিঠে করেছেন। খুব বিনয়ী, বুদ্ধিমান, ভাল ছেলে। পটাশের কেল্লায় যদি তাকে গড়-ভুতুয়া নিয়ে ফেলে থাকে, তা হলে উদ্ধারের আশা একরকম নেই। ওই কেল্লা নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। কিন্তু কিংবদন্তিগুলোও পরস্পরবিরোধী। এই পর্যন্ত মোট ত্রিশ-চল্লিশজন লোক পটাশের গড় দেখতে পেয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু কেউ বলে, গড়ের চারপাশে যে চোরাবালি আছে তা বোঝবার উপায় নেই। লতাপাতা ঘাসের চাঙড় দিয়ে এমন ঢাকা থাকে যে পা দেওয়ার পর বোঝা যায় ঘাসের নিচে চোরাবালি আছে। অনেকে বলে, কেল্লাটাও লতাপাতায় ঢাকা একটা ধ্বংসপ মাত্র। আবার কেউ বলে চোরাবালির ওপর লতাপাতা মোটেই নেই। আর কেল্লাটা মোটেই ধ্বংসস্তূপ নয়, রাত্রিবেলা সেখানে উজ্জ্বল আলো দেখা যায়, ডিনারের ঘন্টার শব্দ পাওয়া যায়। কয়েকজন সাহেব একবার পটাশগড়ের জঙ্গল জরিপ করে মানচিত্র তৈরি করেছিল। সেখানে চোরাবালির কথা আছে, কিন্তু কেল্লার উল্লেখই নেই। অথচ সেই দলেরই একজন সাহেব নাকি এক সন্ধেবেলা ‘ডিনার খেতে যাচ্ছি বলে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর ফেরেনি। তার সঙ্গীদের সন্দেহ, লোকটা হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়ে চোরাবালিতে ডুবে মরেছে। শ্যাম লাহিড়ীর নিজের অভিজ্ঞতা অবশ্য সেই পাগলা-সাহেবের সঙ্গেই মেলে। তিনি একবার পাগলা হাতির খবর পেয়ে পটাশগড়ের জঙ্গলে ঢুকেছিলেন। সঙ্গে জিমি ছিল। সেই সময়ে সন্ধেবেলা তিনিও বাতাসে উড়ো একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন ‘ডিনারের সময় হল। নানা বেভুল রাস্তায় ঘুরপাক খেতে-খেতে যখন চোরাবালির প্রান্তে পৌঁছে গেছেন এবং একটি অন্ধকার ধ্বংসস্তৃপ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেছেন, সেই সময়ে জিমি তাঁর প্যান্ট কামড়ে ধরে প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। অল্পের জন্য তিনি বেঁচে যান। জিমিই তাঁকে পথ দেখিয়ে একরকম টানতে টানতে নিয়ে আসে জঙ্গলের বাইরে।
বেরোবার মুখে বিষ্ণুবাবু এসে ম্লান মুখে বললেন, “ব্যোমকেশবাবু যেতে পারবেন না। তাঁর একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর। কম্বল মুড়ি দিয়ে কোঁ-কোঁ করছেন।”
শ্যাম লাহিড়ী একটু হেসে বললেন, “বলুন গিয়ে, পৌরপিতা হিসেবে তাঁর কিছু কর্তব্য আছে। যদি ভয় খেয়ে থাকেন, তবে তাঁর বদনাম হবে। তিনি যদি একান্তই না যান, তা হলে এবার মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে আমি তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াব।”
বিষ্ণুবাবু চলে গেলেন।
দশ মিনিটের মাথায় শ্যাম লাহিড়ীর বাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে থামল। ব্যোমকেশবাবু প্রকাণ্ড একখানা লাঠি হাতে লাফ দিয়ে নেমে বেশ চেঁচিয়ে রাস্তার লোককে শুনিয়ে বললেন, “শহরের সবচেয়ে বড় বীর ছেলেটা জঙ্গলে হারিয়ে গেল এটা কি ইয়ার্কি নাকি? যতদিন আমার দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ এরকম কাণ্ড বরদাস্ত করব না। ভাইসব, এই আমি চললুম জয়পরাজয়বাবুকে ফিরিয়ে আনতে। না, না, কঠোর কর্তব্যকর্মে আপনারা কেউ আমাকে বাধা দেবেন না। আমি যাবই।”
এই বলে ব্যোমকেশ বাঁদুরে টুপিটা খুলে একগাল হেসে শ্যাম লাহিড়ীকে বললেন, “দাদাও যাচ্ছেন বুঝি? বাঃ বাঃ, বেশ হল।” শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমার নাকি খুব জ্বর?”
ব্যোমকেশ মাথা চুলকে বললেন, “লোকে সারাক্ষণ এসে এত জ্বালাতন করে যে, ওসব একটু বানিয়ে বলতেই হয়। অপরাধ নেবেন না। দিনরাত লোকসেবা করে করে হাড়ে ঘুণ ধরে গেল। তা দাদা কি সত্যিই ইলেকশনে দাঁড়াবেন? আপনি দাঁড়ালে তো আমার আশা নেই।” শ্যাম লাহিড়ী জবাব দিলেন না।
৪. ভুতু যদি কাঁকড়াবিছে ক্লাসে না ছাড়ত
ভুতু যদি কাঁকড়াবিছে ক্লাসে না ছাড়ত তা হলে সে ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলের ফুটবল টিমে চান্স পেত। যদি ফুটবল টিমে চান্স পেত তা হলে সে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কালুকে খেপাত না। কালু যদি না খেপত, তা হলে জয়পতাকাবাবুর মতো ভীতু আর নিরীহ লোকের ভিতরে বীরত্ব জেগে উঠত না। বীরত্ব না জাগলে এত লোক আজ জয়পতাকাবাবুকে মাটাডোরের ভূমিকায় দেখতে পেত না এবং মস্ত বড় একটা অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হত। আর ষাঁড়ের লড়াই না হলে জয়পতাকাবাবু কোনওদিনই কালুর পিঠে চড়ার মতো বিরল অভিজ্ঞতা লাভ করতেন না। আর তা হলে পটাশগড়ের জঙ্গলটাও তাঁর কাছে অজানা থেকে যেত। জয়পতাকাবাবু নিরুদ্দেশ না হলে স্কুল কাল বন্ধ দেওয়া হত না। এবং আগামী কাল ভুতুকে জয়পতাকার ক্লাসে অঙ্কের জন্য বিস্তর নাকাল হতে হত। সুতরাং সব দিক ভেবে দেখলে, যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে। এরকম একখানা কাণ্ড হওয়ার দরকার ছিল।