লোক নয়। কোট-পরা একটা সিংহ।
পল্টু হয়তো আবার জলায় লাফিয়ে পড়ত।
কিন্তু সামনের নৌকো থেকে সেই সিংহ গম্ভীর গলায় বলল, “ভয় পেও না। আমার মুখে একটা রবারের মুখোশ রয়েছে।”
পল্টুর গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছিল না। অনেক কষ্টে সে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“আমার মুখটা দেখতে খুব ভাল নয় বলে।”
কথাটা পল্টুর বিশ্বাস হল না। ভয়ে ভয়ে সে আবার জিজ্ঞেস করল, “দেখতে ভাল নয় মানে?”
নৃসিংহর দু হাতে দুটো বৈঠা। খুব অনায়াস ভঙ্গিতে নৃসিংহ তার লম্বা নৌকোটাকে জলার ওপর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোনও ক্লান্তি বা কষ্টের লক্ষণ নেই। এমন কি তেমন একটা হাঁফাচ্ছেও না। স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমার মুখে একবার অ্যাসিড লেগে অনেকখানি পুড়ে যায়। খুব বীভৎস দেখতে হয় মুখটা। সেই থেকে আমি মুখোশ পরে থাকি।” ৪২
“সিংহের মুখোশ কেন?”
“আমার অনেক রকম মুখোশ আছে। যখন যেটা ইচ্ছে পরি। তুমি অত কথা বোলো না। জিরোও।”
পল্টু জিজ্ঞেস করল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“জলার ওদিকে।”
“ওদিকে মানে কি শহরের দিকে?”
“না। উল্টোদিকে।”
“কেন?”
“একজনের হুকুমে।”
“কিসের হুকুম?”
“তোমাকে তার কাছে নিয়ে হাজির করতে হবে।”
“তিনি কে?”
“তা বলা বারণ। অবশ্য আমিও তাকে চিনি না।”
“আপনি কে?”
“আমি তো আমিই।”
“আমি যাব না। আমাকে নামিয়ে দিন।”
“এই জলায় কুমির আছে, জানো?”
“থাকুক। আমি নেমে যাব। আমাকে নামতে দিন।”
“তুমি ভয় পেয়েছ। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই।”
“আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। মামা ভাবছে। আমি বাড়ি যাব।”
“যেখানে যাচ্ছ সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তোমার মামা এতক্ষণে তোমার খবর পেয়ে গেছে। ওসব নিয়ে ভেবো না। আমরা কাঁচা কাজ করি না।”
“আমাকে নিয়ে গিয়ে কী করবেন?”
“কিছু নয়। বোধহয় তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করা হবে। তারপর ছাড়া পাবে।”
“কিসের প্রশ্ন?”
“বোধহয় গয়েশবাবুকে নিয়ে। কিন্তু আর কথা নয়।”
পল্টু শুনেছে জলার মাঝখানে জল খুব গভীর। কুমিরের গুজবও সে জানে। আর জলায় ভূত-প্রেত আছে বলেও অনেকের ধারণা। সেসব বিশ্বাস করে না পল্টু। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে, জলাটা খুব নিরাপদ জায়গা নয়।
ধুধু করছে সাদা জল। শীতকালেও খুব শুকিয়ে যায়নি। তবে এখানে-ওখানে চরের মতো জমি জেগে আছে। তাতে জংলা গাছ। প্রচুর পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়েছে, ছোঁ মেরে মাছ তুলে নিচ্ছে জল থেকে। ভারী সুন্দর শান্ত চারদিক। আলোয় ঝলমলে। তার মাঝখানে বাচ-নৌকোয় ওই নৃসিংহ লোকটা ভারী বেমানান। তেমনি রহস্যময় তার এই নিরুদ্দেশ-যাত্রা।
গলা খাঁকারি দিয়ে পটু জিজ্ঞেস করল, “আর কত দূর?”
“এসে গেছি। ওই যে দেখছ বড় একটা চর, ওইটা।”
চরটা দেখতে পাচ্ছিল পল্টু। খুব বড় নয়। লম্বায় বোধহয় একশো ফুট হবে। তবে অনেক বড় বড় গাছের ঘন জঙ্গল আছে। বেশ অন্ধকার আর রহস্যময় দেখাচ্ছিল এই ফটফটে দিনের আলোতেও। কোনও লোকবসতি নেই বলেই মনে হয়।
পটুর ভয় খানিকটা কেটেছে। একটু মরিয়া ভাব এসেছে। সে জিজ্ঞেস করল, “ওখানেই কি তিনি থাকেন?”
“থাকেন না, তবে এখন আছেন।” বলতে বলতে লোকটা তার লম্বা নৌকোটাকে বৈঠার দুটো জোরালো টানে অগভীর জলে চরের একেবারে ধারে নিয়ে তুলল। জলের নীচের জমিতে নৌকোর ঘষটানির শব্দ হল। লোকটা উঠে এক লাফে জলে নেমে বলল, “এসো।”
দড়ির টানে পল্টুর ডিঙিটাও বাচ-নৌকোর গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পল্টু নেমে দেখল, জল সামান্যই। এদিকে হোগলাবন নেই। জল টলটলে পরিষ্কার এবং একটু স্রোতও আছে। সে শুনেছে এদিকে বড় গাঙের সঙ্গে জলার একটা যোগ আছে। সম্ভবত তারা সেই গাঙের কাছাকাছি এসে গেছে।
নৃসিংহ খাড়াই পার বেয়ে ওপরে উঠে দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য। লোকটা খুব লম্বা নয় বটে, তবে বেশ চওড়া। গায়ে কোট থাকলেও বোঝা যাচ্ছিল, লোকটার স্বাস্থ্য ভাল এবং পেটানো, হওয়াই স্বাভাবিক। এতটা রাস্তা দুটো বৈঠার জোরে দুখানা নৌকো টেনে আনা কম কথা নয়।
পল্টু ধীরে-ধীরে ওপরে উঠে এল। লোকটা তার কাছ থেকে একটু তফাতে সরে গিয়ে জঙ্গলটার দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলল, “এগিয়ে যাও।”
“কোথায় যাব?”
“সোজা এগিয়ে যাও, ওখানে লোক আছে, নিয়ে যাবে।”
একটু ইতস্তত করল পল্টু। জঙ্গলের দিকে কোনও রাস্তা নেই। বিশাল বড় বড় গাছ, লতাপাতা বুক-সমান আগাছায় ভরা। শুধু পাখির ডাক আর গাছে বাতাসের শব্দ। জঙ্গলটা খুবই প্রাচীন। কিন্তু লোকবসতির কোনও চিহ্ন নেই। এই জঙ্গলে কে তার জন্য অপেক্ষা করছে? কী প্রশ্নই বা সে করতে চায়? গয়েশবাবু সম্পর্কে তার জানার এত আগ্রহই বা কেন?
দোনোমোনো করে পল্টু এগোল। একবার নৃসিংহের দিকে আচমকাই ফিরে তাকাল সে। অবাক হয়ে দেখল, নৃসিংহের হাতে একটা কালো রঙের বল। লোকটা ধীরে-ধীরে হাতটা ওপরদিকে তুলছে।
এত অবাক হয়ে গিয়েছিল পল্টু যে, হাঁ করে তাকিয়ে রইল, মুখে কথা এল না। বল কেন লোকটার হাতে?
লোকটা ধমকে উঠল, “কী হল?”
“বল নিয়ে আপনি কী করছেন?”
“কিছু নয়। যা বলছি করো। এগোও।”
পল্টু মুখ ফিরিয়ে জঙ্গলটার দিকে তাকাল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই মাথার পিছনে দুম করে কী একটা এসে লাগল।
সেই বলটা? ভাবতে-না-ভাবতেই তীব্র ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখল সে। পেটে চিনচিনে খিদে; শীত আর ভয়ে এমনিতেই তার শরীর কাঁপছিল। মাথায় বলটা এসে লাগতেই শরীরটা অবশ হয়ে পড়ে যেতে লাগল মাটিতে। হাত বাড়িয়ে শূন্যে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল পল্টু। কিছু পেল না।