পল্টু প্রাণপণে হোগলা সরিয়ে সরিয়ে এগোতে থাকে। জল ভেঙে হাঁটা ভারী শক্ত। পায়ের নীচে থকথকে কাদা থাকায় হাঁটাটা দুগুণ শক্ত হয়েছে। পল্টু এই শীতেও ঘামতে লাগল। কিন্তু থামলে চলবে না। এগোতে হবে। যেদিকেই হোক, ডাঙা জমিতে কোনওরকমে গিয়ে উঠতে পারলে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে।
পল্টু যত এগোয় তত জল বাড়ে। ক্রমে তার বুক সমান হয়ে এল। সে সাঁতার জানে বটে, কিন্তু এই হোগলাবনে সাঁতার জানলেও লাভ নেই। হাত পা ছুঁড়ে তো আর জলে ভেসে থাকা সম্ভব নয়।
সূর্য প্রায় মাথার ওপর থাকায় দিক নির্ণয়ও করতে পারছিল না সে। এই সময়ে উত্তরের হাওয়া বয়। হোগলাবনেও সেই হাওয়ার ঝাঁপট এসে লাগছে বটে, কিন্তু কোন দিক থেকে আসছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে না।
জল যখন প্রায় গলা অবধি পৌঁছে গেছে, তখন থেমে একটু দম নিল পল্টু। এরকম পঙ্কিল ঘিনঘিনে পচা জলে বহুক্ষণ থাকার ফলে তার সারা গা চুলকোচ্ছে। তার সঙ্গে মশা আর জোঁকের কামড় তো আছেই। শামুকের খোল, ভাঙা কাঁচ, পাথরের টুকরোয় তার দুটো পায়েরই তলা ক্ষতবিক্ষত। ভীষণ তেষ্টায় গলা অবধি শুকিয়ে কাঠ। খিদেয় চোঁ চোঁ করছে পেট। মাথা ঝিম ঝিম করছে, শরীরটা ভেঙে আসছে পরিশ্রমে।
হঠাৎ সে হোগলাবনে একটা সড়সড় শব্দ শুনতে পেল। সেই সঙ্গে জল ভাঙার শব্দ। কেউ কি আসছে?
পল্টু কাতর গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “আমি বড় বিপদে পড়েছি। কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন?”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা গম্ভীর গলা জবাব দিল, “যেখানে আছ সেখানেই থাকো। আমি আসছি।”
পল্টু তবু বলল, “আমি এখানে।”
“তুমি কোথায় তা আমি জানি। কিন্তু নোছড়া না। তোমার সামনেই একটা দহ আছে। দহে পড়লে ডুবে যাবে।”
পল্টু একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলল। হোগলা পাতার ঘন বনে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু শব্দটা যে এগিয়ে আসছে তার দিকে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। খুব কাছেই গাছগুলোর ডগা নড়তে দেখল সে। উৎসাহের চোখে দু-তিন পা এগিয়ে গেল সে। চেঁচিয়ে বলল, “এই যে আমি।”
কিন্তু এবার আর সাড়া এল না।
আস্তে আস্তে গাছগুলো ঠেলে একটা সরু ডিঙির মুখ এগিয়ে আসে তার দিকে। খুব ধীরে ধীরে আসছে।
পল্টু অবাক হয়ে দেখল, ডিঙিটায় কোনও লোক নেই। নিতান্তই ছোট্ট ডিঙি লম্বায় তিন হাতও বোধহয় হবে না। আর ভীষণ সরু। ব্যাপারটা অদ্ভুত। লোকছাড়া একটা ডিঙি কী করে এই ঘন হোগলাবনে চলছে? ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি?
গম্ভীর স্বরটা একটু দূর থেকে বলে উঠল, “ভয় নেই, উঠে পড়ো। সাবধানে ওঠো। ডিঙি ডুবে যেতে পারে। সরু ডগার দিকটা ধরে যেভাবে লোকে ঘোডার পিঠে ওঠে, তেমনি করে ওঠো।”
কাণ্ডটা ভুতুড়ে হোক বা না হোক, সেসব বিচার করার মতো অবস্থা এখন পল্টুর নয়। সে বার কয়েকের চেষ্টায় ডিঙির ওপর উঠে পড়তে পারল। একটু দুলে ডিঙিটা আবার সোজা এবং স্থির হল।
পল্টু প্রথমেই দেখতে পেল, তার পায়ে অন্তত দশ বারোটা জোঁক লেগে রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে আছে। ভয়ে সে একটা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল। আঙুলে চেপে ধরে যে জোঁকগুলোকে ছাড়াবে সেই সাহসটুকু পর্যন্ত নেই। গা ঘিনঘিন করতে লাগল তার। পা দুটো ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, জলে ভিজে স্যাঁতা হয়ে কুঁচকে গেছে গায়ের চামড়া। আর ভেজা পোশাকে শীতের হাওয়া লাগতেই ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল সে।
কিন্তু তারপর যা ঘটল তাতে ভয়ে তার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা। ডিঙিটায় উঠবার মিনিটখানেক বাদে আচমকাই সেটা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলতে লাগল।
“ভূত! ভূত!” পল্টু চেঁচাল।
হাত দশেক দূর থেকে সেই কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “ভূত নয়। পল্টু। ভয় খেও না। তোমার ডিঙিটা দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে আর একটা নৌকোর সঙ্গে।”
পল্টু ঝুঁকে দেখল, কথাটা মিথ্যে নয়। ডিঙিটার নীচের দিকে একটা লোহার আংটা লাগানো। তাতে দড়ি বাঁধা। দড়িটা টান টান হয়ে আছে। অর্থাৎ কেউ টেনে নিচ্ছে ডিঙিটাকে।
সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে?”
জবাবে পাল্টা একটা প্রশ্ন এল, “আগে বলো কাল রাত্রে তুমি সত্যিই গয়েশবাবুকে দেখেছিলে কি না।”
পল্টু একটু চমকে উঠল। এখন আর মিথ্যে কথা বলার মতো অবস্থা তার নয়।
পল্টু ভয়ে-ভয়ে বলল, “দেখেছি। তবে দারোগাবাবুকে যা বলেছি তা ঠিক নয়।”
“তুমি একটু ফাজিল, তাই না?”
পল্টু চুপ করে রইল। হোগলাবনের ভিতর দিয়ে তার ডিঙি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না সে। সামনের নৌকোয় কে রয়েছে, বন্ধু না শত্রু, তাই বা কে বলে দেবে?
গয়েশবাবুর খুন বা নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনাটা যে খুব এলেবেলে ব্যাপার নয়, তা একটু একটু বুঝতে পারছিল পল্টু। বুঝতে পেরে তার শরীরের ভিতর গুড়গুঁড়িয়ে উঠছিল একটা ভয়। জলার মধ্যে হোগলাবনের গোলকধাঁধা থেকে কোন অশরীরী তাকে কোথায় নিয়ে চলেছে?
হোগলাবনটা একটু হালকা হয়ে এল। এর মধ্যে নৌকো চালানো খুব সহজ কাজ নয়। যে নৌকোটা তার ডিঙিটাকে টেনে নিচ্ছে, তার চালকের এতক্ষণে আঁফিয়ে পড়ার কথা।
বন ছেড়ে জলার মাঝ-মধ্যিখানে ক্রমে চলে এল পল্টুর ডিঙি। ফাঁকায় আসতেই সে সামনের নৌকোটা দেখতে পেল। মাত্র হাত দশেক সামনে বাইচ খেলার সরু লম্বা নৌকোর মতো একটা নৌকো। খুব লম্বা, সাদা। তাতে একটিই তোক বসে আছে, আর পল্টুর দিকে মুখ করেই। গায়ে একটা লম্বা কালো কোট। কিন্তু মুখটা? পল্টুর শরীরে একটা ঠাণ্ডা ভয়ের সাপ জড়িয়ে গেল। বুকটা দমাস-দমাস করে শব্দ করতে লাগল।