“আমারও সেই প্রশ্ন। তা কী করে হয়। আমি চোখ কচলে গায়ে চিমটি দিয়ে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, চোখের ভুল নয়। দুজনেই গয়েশবাবু। এক চেহারা, এক পোশাক, শুধু দুজনের হাঁটাটা দুরকম।”
“ঠিক করে বলো। সত্যি দেখেছ, না হ্যালুসিনেশান?”
“আপনাকে ছুঁয়ে দিব্যি করতে পারি। একেবারে জলজ্যান্ত চোখের দেখা।”
“তুমি তখন কী করলে?”
“আমি তখন বহুবচনে বললাম, গয়েশকাকারা, কোথায় যাচ্ছেন এই নিশুতি রাত্তিরে? কিন্তু তাঁরা তবু ভূক্ষেপ করলেন না। আমাকে যেন দেখতে পাননি এমনভাবে এগিয়ে আসতে লাগলেন।”
“আর তুমি দাঁড়িয়ে রইলে?”
“পিছোনোর উপায় ছিল না। রাস্তা জুড়ে আমার পিছনে একটা মস্ত ষাঁড় শুয়ে ছিল যে! আমি বললাম, কাকারা, থামুন। আপনারা ঘুমের মধ্যে হাঁটছেন। কিন্তু তাঁরা আমাকে পাত্তাই দিলেন না। সোজা হেঁটে এসে আমাকে ভেদ করে চলে গেলেন।”
“ভেদ করে?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। ভেদ করা ছাড়া আর কী বলা যায়? আমার ওপর দিয়েই গেলেন কিন্তু এতটুকু ছোঁয়া লাগল না। গয়েশবাবু খোঁড়া গয়েশবাবুকে তখন বলছিলেন…”
অস্ফুট একটা ‘রাম-রাম’ ধ্বনি দিয়ে বজ্রাঙ্গ হুহুংকারে বলে উঠলেন, “দ্যাখো, তোমাকে সোজা বলে দিচ্ছি, সরকারি কাজে বাধার সৃষ্টি করা রাজদ্রোহিতার সামিল।”
পল্টু অবাক হয়ে বলে, “আমি আবার সরকারি কাজে কখন বাধা দিলাম?”।
বজ্ৰাঙ্গ চোখ পাকিয়ে বললেন, “এই যে ভূতের গল্প বলে তুমি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ এটা সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কী হতে পারে? আমি ভয় পেয়ে গেলে তদন্ত হবে কী করে?”
সকলেরই একটু-আধটু হাসি পাচ্ছে, কিন্তু কেউ হাসতে সাহস পাচ্ছে না। পল্টু করুণ মুখ করে বলল, “ঘটনাটা ভৌতিক নাও হতে পারে। হয়তো ও দুটো গয়েশকাকুর ট্রাই ডাইমেনশনাল ইমেজ।”
বজ্রাঙ্গ হুংকর দিলেন, “মানে?”
পল্টু ভয়ে-ভয়ে বলে, “ত্রিমাত্রিক ছবি।”
“ছবি কখনও হেঁটে বেড়ায়? ইয়ার্কি করছ?”
“কেন, সিনেমার ছবিতে তো লোকে হাঁটে।”
বজ্ৰাঙ্গ দ্বিধায় পড়ে গেলেন বটে, কিন্তু হার মানলেন না। ঝড়াক করে একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “যথেষ্ট হয়েছে। তোমার স্টেটমেন্ট আর নেওয়া হবে না।”
পল্টু মুখোনা কাঁদো কাঁদো করে বলে, “আমি কিন্তু গুল মারছিলাম না। বলছিলাম কী, ঘটনাটা আরও ভাল করে ইনভেসটিগেট করা দরকার। এর পিছনে হয়তো একটা বৈজ্ঞানিক চক্রান্ত আছে।”
কিন্তু তাকে পাত্তা না দিয়ে বজ্রাঙ্গ চতুর্দিকে বার কয়েক চোখ বুলিয়ে ভুকুটি করে হুংকার ছাড়লেন, “আর কারও কিছু বলার আছে? কিন্তু খবর্দার, কেউ গুলগপ্পো ঝাড়লে বিপদ হবে।”
কারও কিছু বলার ছিল না। সুতরাং আর একবার কটমট করে চারদিকে চেয়ে বজ্ৰাঙ্গ বিদায় নিলেন।
৫. পল্টুও সুট করে কেটে পড়েছিল
বজ্রাঙ্গ বোস বিদায় নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই পল্টুও সুট করে কেটে পড়েছিল।
গয়েশবাবুর নিরুদ্দেশ হওয়ার তদন্ত যে এখন বেশ ঘোরালো হয়ে উঠবে, তা ভেবে খুব হাসি পাচ্ছিল তার। কিন্তু শহরে একটা প্রায় শোকের ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রকাশ্য স্থানে দম ফাটিয়ে আসাটা উচিত হবে না। লোকে সন্দেহ করবে। তাই সে গয়েশবাবুর বাড়ির পিছন দিককার জলার মধ্যে হোগলার বনে গিয়ে ঢুকে পড়ল। জায়গাটা বিপজ্জনক। একে তো বরফের মতো ঠাণ্ডা জল, তার ওপর জলে সাপখোপ আছে, জোঁক তো অগুনতি, পচা জলে বীজাণুও থাকার কথা। কিন্তু হাসিতে পেটটা এমনই গুড়গুড় করছে পল্টুর যে, বিপদের কথা ভুলে সে হোগলার বনে ঢুকে হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ করে হাসতে লাগল।
কিন্তু আচমকাই হাসিটা থেমে গেল তার। হঠাৎ সে লক্ষ করল, চারদিকে লম্বা লম্বা হোগলার নিবিড় জঙ্গল। এত ঘন যে, বাইরের কিছুই নজরে পড়ে না। সে কলকাতার ছেলে। এইরকম ঘন জঙ্গল সে কখনও দেখিনি। হাঁটু পর্যন্ত জলে সে দাঁড়িয়ে আছে বটে, কিন্তু পায়ের নীচে নরম কাদায় ধীরে-ধীরে পা আরও ডেবে যাচ্ছে তার। চারদিকে এই দুপুরেও অবিরল ঝি ঝি ডাকছে। দু-একটা জলচর পাখি ঘুরছে মাথার ওপর। বাইরের কোনও শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
পটু একটু ভয় খেল। যদিও দিনের বেলা ভয়ের কিছু নেই, তবু কেমন ভয়-ভয় করছিল তার। জলকাদা ভেঙে সে ফিরে আসতে লাগল।
কিন্তু ফিরে আসতে গিয়েই হল মুশকিল। নিবিড় সেই হোগলাবনে কোথা দিয়ে সে ঢুকেছিল, তা গুলিয়ে ফেলেছে। যেদিক দিয়েই বেরোতে যায়, সেদিকেই শুধু জল আর আরও হোগলা। আর জলাটাও বিদঘুঁটে। এতক্ষণ হাঁটুজল ছিল, এখন যেন জলটা হাঁটু ছাড়িয়ে আরও এক বিঘত উঠে এসেছে। পায়ের নীচে পাঁক আরও আঠালো।
কলকাতার ছেলে বলে পল্টুর একটু দেমাক ছিল। সে চালাক চতুর এবং সাহসীও বটে। কিন্তু এই হোগলাবনে পথ হারিয়ে সে দিশাহারা হয়ে গেল। পাঁকের মধ্যে পা ঘেঁষে পাঁকাল মাছ বা সাপ গোছের কিছু সড়ত করে সরে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে, আর চমকে উঠছে পল্টু। হোগলার বনে উত্তরের বাতাসে একটা হু হু শব্দ উঠছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে সে লোকালয়ের শব্দ শুনবার চেষ্টা করল। কোনও শব্দ কানে এল না।
পল্টু চেঁচিয়ে ডাকল, “মামা! ও মামা?”
কারও সাড়া নেই।
পল্টু আরও জোরে চেঁচাল, “কে কোথায় আছ? আমি বিপদে পড়েছি।”
তবু কারও সাড়া নেই। এদিকে জলার জল পল্টুর কোমর-সমান হয়ে এল প্রায়। কাদা আরও গভীর। ভাল করে হাঁটতে পারছে না পল্টু। হোগলার বন আরও ঘন হয়ে আসছে। দিনের বেলাতেও নাড়া খেয়ে জলার মশারা হাজারে হাজারে এসে হেঁকে ধরেছে তাকে। পায়ে জোঁকও লেগেছে, তবে জোঁক লাগলে কেমন অনুভূতি হয় তা জানা নেই বলে রক্ষা। দু পায়ের অন্তত চার জায়গায় মৃদু চুলকুনি আর সুড়সুড়ির মতো লাগছে। কিন্তু সেই জায়গাগুলো আর পরীক্ষা করে দেখল না পল্টু।