গম্ভীরতর হয়ে বজ্রাঙ্গবাবু বললেন, “ঘড়ির কথা পরে হবে। আগে গয়েশবাবুর কথাটা শুনি।”
“ও হ্যাঁ। তখন নিশুতি রাত। হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম, একটা লোক নিজের কাটা মুণ্ডু হাতে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই দেখে ভয়ে”
বজ্রাঙ্গবাবুর মুখটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ভূত তিনি মোটেই সইতে পারেন না। সামলে নিয়ে বললেন, “দ্যাখো ছোঁকরা, বেয়াদবি করবে তো তোমার মুণ্ডুটাও–”
“আচ্ছা, তাহলে বলব না। “ বলে পল্টু মুখে কুলুপ আঁটে।
বজ্রাঙ্গবাবু একটু মোলায়েম হয়ে বলেন, “বলবে না কেন? বলো। তবে ওইসব স্বপ্নের ব্যাপার-ট্যাপারগুলো বাদ দেওয়াই ভাল। ওগুলো তো ইররেলেভ্যাণ্ট।”
পল্টু মাথা নেড়ে বলে, “আপনার কাছে ইররেলেভ্যাণ্ট হলেও আমার কাছে নয়। স্বপ্নটা না দেখলে আমার ঘুম ভাঙত না। আর ঘুম না ভাঙলে গয়েশবাবুকেও আমি দেখতে পেতাম না।”
“আচ্ছা বলো।” বজ্রাঙ্গবাবু বিরস মুখে বলেন।
“আমি শুই মামাবাড়ির ছাদে একটা চিলেকোঠায়। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমার আর ঘুম আসছিল না। কী আর করি? উঠে সেই শীতের মধেই ছাদে একটু পায়চারি করছিলাম। তখন হঠাৎ শুনি, নীচের রাস্তায় কাদের যেন ফিসফাস কথা শোনা যাচ্ছে। উঁকি মেরে দেখি, গয়েশবাবু একজন লোকের সঙ্গে খুব আস্তে-আস্তে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছেন।”
“লোকটাকে লক্ষ করেছ?”
“করেছি। রাস্তায় তেমন ভাল আলো ছিল না। তাই অস্পষ্ট দেখলাম। তবে মনে হল লোকটা বাঁ পায়ে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে।”
“কতটা লম্বা?”
“তা গয়েশবাবুর মতোই হাইট হবে।”
“চেহারাটা দেখনি? মুখটা?”
“প্রথমটায় নয়। ওপর থেকে মনে হচ্ছিল, লোকটার হাইট স্বাস্থ্য সবকিছুই গয়েশবাবুর মতো।”
“তাদের কথাবার্তা কিছু কানে এসেছিল?”
“আজ্ঞে না। তবে মনে হচ্ছিল তাঁরা দুজন খুব গুরুতর কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। গয়েশবাবুকে দেখে আমি ছাদ থেকে বেশ জোরে একটা হাঁক দিলাম, গয়েশকাকা-আ-আ…”
পল্টু এত জোরে চেঁচাল যে, বজ্ৰাঙ্গ পর্যন্ত কানে হাত দিয়ে বলে ওঠেন, “ওরে বাপ রে! কানে তালা ধরিয়ে দিলে!”
পল্টু ভালমানুষের মতো মুখ করে বলে, “যা ঘটেছিল তা হুবহু বর্ণনার চেষ্টা করছি।”
“অত হুবহু না হলেও চলবে বাপু। একটু কাটছাঁট করতে পারো। যাক, তুমি তো ডাকলে। তারপর গয়েশবাবু কী করলেন?”
“সেইটেই তো আশ্চর্যের। গয়েশবাবুর সঙ্গে আমার খুব খাতির। উনি আমাকে নিয়ে প্রায়ই বড় ঝিলে মাছ ধরতে যান, চন্দ্রগড়ের জঙ্গলে আমি ওঁর সঙ্গে পাখি শিকার করতেও গেছি। ইদানীং দাবার তালিম নিচ্ছিলাম। যাঁর সঙ্গে এত খাতির, সেই গয়েশবাবু আমার ডাকে সাড়াই দিলেন না।”
“কানে কম শুনতেন নাকি?”
“মোটেই না। বরং খুব ভাল শুনতেন। উনি তো বলতেন, গহিন রাতে আমি পিঁপড়েদের কথাবার্তাও শুনতে পাই।”
“বলো কী! পিঁপড়েরা কথাবার্তা বলে নাকি?”
“খুব বলে। দেখেননি দুটো পিঁপড়ে মুখোমুখি হলেই একটু থেমে একে অন্যের খবরবাতা নেয়? পিঁপড়েরা স্বভাবে ভারী ভদ্রলোক।”
“আচ্ছা, পিঁপড়েদের কথা আর-একদিন শুনিয়ে দিও। এবার গয়েশবাবু…?”
“হ্যাঁ। গয়েশবাবু তো আমার ডাকে সূক্ষেপ করলেন না। আমার কেমন মনে হল, আমি ভাল করে গয়েশবাবুর হাঁটাটা লক্ষ করলাম। আমার মনে হল, উনি খুব স্বাভাবিকভাবে হাঁটছেন না, কেমন যেন ভেসে-ভেসে চলে যাচ্ছেন।”
“ভেসে-ভেসে?”
“ভেসে-ভেসে। যেন মাটিতে পা পড়ছে না। শুনেছি অনেক সময় লোকে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে হাঁটে। সে হাঁটা কেমন তা আমি দেখিনি। কিন্তু গয়েশবাবুকে দেখে মনে হল, উনি বোধহয় ঘুমিয়ে-ঘুমিয়েই হাঁটছেন, তাই আমার ডাক শুনতে পাননি। আমি তাড়াতাড়ি নীচে নেমে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম।”
“পড়লে?”
“উপায় কী বলুন? ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে হাঁটা তো ভাল অভ্যাস নয়। হয়তো খানাখন্দে পড়ে যাবেন, কিংবা গাছে বা দেয়ালে ধাক্কা খাবেন।”
“সঙ্গে একটা খোঁড়া লোক ছিল বলছিলে যে!”
“ছিল। কিন্তু দুজনেরই হাঁটা অনেকটা এরকম। দুজনেই যেন ভেসে-ভেসে যাচ্ছেন। দুজনেই যেন ঘুমন্ত।”
“গুল মারছ না তো?” বজ্রাঙ্গ হঠাৎ সন্দেহের গলায় বলেন।
“আজ্ঞে না। গুল মারা খুব খারাপ। কলকাতার ছেলেরা মফস্বলে গেলে গুল মারে বটে, কিন্তু আমি সে-দলে নই।”
“আচ্ছা বলো। তুমি তো বাড়ি থেকে বেরোলে–”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। বেরিয়েই আমি দৌড়ে গয়েশবাবুর কাছে পৌঁছে গিয়ে ডাক দিলাম, গয়েশকা–”।
“থাক থাক, এবার আর ডাকটা শোনাতে হবে না।”
পল্টু অভিমানভরে বলে, “কাছে গিয়ে তো চেঁচিয়ে ডাকিনি। আস্তে ডেকেছি।”
“ও। আচ্ছা, বলো।”
“ডাকলাম। কিন্তু এবারও গয়েশবাবু ফিরে তাকালেন না। তখন আমার স্থির বিশ্বাস হল, গয়েশবাবু জেগে নেই। আমি তখন ওঁদের পেরিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লাম। দাঁড়িয়ে যা দেখতে পেলুম তা আর বলার ভাষা আমার নেই। ওঃ…বাবা রে…”
বজ্রাঙ্গ নড়েচড়ে বসে পিস্তলের খাপে একবার হাত ঠেকিয়ে বললেন, “কাতুকুতু দিতে হবে নাকি?”
“না না, বলছি। ভাষাটা একটু ঠিক করে নিচ্ছি আর কি। দেখলাম কি জানেন? দেখলাম, খোঁড়া লোকটাও গয়েশবাবু, না–খোঁড়া লোকটাও গয়েশবাবু।”
“তার মানে?”
“অর্থাৎ দুজন গয়েশবাবু পাশাপাশি হাঁটছে।”
ফের গাঁক করলেন বাঙ্গ, “তা কী করে হয়?”