বজ্রাঙ্গ বোস গয়েশবাবুর বাড়িটা ঘুরে-ঘুরে দেখলেন। বিরাট বাড়ি। সামনে এবং পিছনে মস্ত বাগান। তবে সে বাগানের যত্ন নেই বলে আগাছায় ভরে আছে। নীচে আর ওপরে মিলিয়ে দোতলা বাড়িটাতে খান আষ্টেক ঘর। তার বেশির ভাগই বন্ধ। নীচের তলায় শুধু সামনের বৈঠকখানা আর তার পাশের শোবার ঘরটা ব্যবহার করতেন গয়েশবাবু। বৈঠকখানায় পুরনো আমলের সোফা, কৌচ, বইয়ের আলমারি, একটা নিচু তক্তপোশের ওপর ফরাস পাতা, তার ওপর কয়েকটা তাকিয়া। শোবার ঘরে মস্ত একটা বাহারি খাট, দেওয়াল আলমারি, জানালার ধারে লেখাপড়ার জন্য টেবিল চেয়ার। জল রাখার জন্য একটা টুল রয়েছে বিছানার পাশে। খাটের নীচে গোটা দুই তোরঙ্গ। সবই হাঁটকে-মাটকে দেখলেন বজ্রাঙ্গ। তেমন সন্দেহজনক কিছু পেলেন না।
গয়েশবাবুর রান্না ও কাজের লোক ব্রজকিশোর হাউমাউ করে কেঁদে বজ্ৰাঙ্গর মোটা-মোটা দু’খানা পা জড়িয়ে ধরে বলে, “বড়বাবু, আমি কিছু জানি না।”
বজ্ৰাঙ্গ বজ্ৰাদপি কঠোর স্বরে বললেন, “কী হয়েছিল ঠিক ঠিক বল।”
ব্রজকিশোর কাঁধের গামছায় চোখ মুছে বলল, “আজ্ঞে, বাবু রাতের খাওয়ার পর একটু পায়চারি করতে বেরোতেন। হাতে টর্চ আর লাঠি থাকত। সেদিনও রাত দশটা নাগাদ বেরিয়েছিলেন। বাবু ফিরলে তবে আমি রোজ শুতে যাই। সেদিনও বাবুর জন্য বসে ছিলাম। সামনের বারান্দায় বসে ঢুলছি আর মশা তাড়াচ্ছি। করতে করতে রাত হয়ে গেল। বড় ঘড়িতে এগারোটা বাজল। তারপর বারোটা। আমি ঢুলতে-দুলতে কখন গামছাখানা পেতে শুয়ে পড়েছি আজ্ঞে। মাঝরাতে কে যেন কানে কানে ফিসফিস করে বলল, এখনও ঘুমোচ্ছিস আহাম্মক? গয়েশবাবুকে যে কেটে দুখানা করে ধড়টা নদীর জলে ভাসিয়ে দিল আর মুণ্ডুটা ঝুলিয়ে দিল গাছে। সেকথা শুনে আমি আঁতকে জেগে উঠে দেখি সদর দরজা খোলা। বাবু তখনও ফেরেনি। তখন ভয় খেয়ে আশপাশের লোকজন ডেকে দু’চারজনকে জুটিয়ে বাবুকে খুঁজতে বেরোই। ভোররাতের আলোয় ভাল ঠাহর পাইনি বড়বাবু, তাই
নদীর জলে যা ভাসছিল, সেটাকেই বাবুর ধড় আর গাছের ডালে যেটা ঝুলছিল সেটাকেই বাবুর মুণ্ডু বলে ঠাহর হয়েছিল আমাদের। কিন্তু বাবুর যে সত্যি কী হয়েছে তা জানি না।”
বজ্ৰাঙ্গ ধমক দিয়ে বলেন, “টর্চ আর লাঠির কী হল?”।
ব্রজকিশোর জিব কেটে নিজের কান ছুঁয়ে বলল, “একেবারে মনে ছিল না আজ্ঞে। হাঁ, সে দুটো আমরা কুড়িয়ে পেয়েছি, টর্চটা নদীর ধারে পড়ে ছিল, লাঠিটা সেই অলক্ষুণে শিমুলগাছের তলায়।”
“আর লোকটা নিরুদ্দেশ?”
“আজ্ঞে।”
কথাবার্তা হচ্ছে সামনের বারান্দায়। বজ্রাঙ্গ চেয়ারের ওপর বসা, পায়ের কাছে ব্রজকিশোর। পুলিশ এসেছে শুনে বিস্তর লোক জড়ো হয়েছে সামনে। রামরিখ, সুমন্তবাবু, সান্টু, মঙ্গল, মৃদঙ্গবাবু, নেপাল, কে নয়? বজ্রাঙ্গ তাদের দিকে চেয়ে একটা বিকট হাঁক দিয়ে বললেন, “তাহলে গেল কোথায় লোকটা?”
বজ্ৰাঙ্গের হাঁক শুনে ভিড়টা তিন পা হটে গেল।
বজ্ৰাঙ্গ কটমট করে লোকগুলোর দিকে চেয়ে বললেন, “নিরুদ্দেশ হলেই হল? দেশে আইন নেই? সরকার নেই? যে যার খুশিমতো খবরবার্তা না দিয়ে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলেই হল? এই আপনাদের বলে দিচ্ছি, এরপর থানায় ইনফরমেশন না দিয়ে কারও নিরুদ্দেশ হওয়া চলবে না। বুঝেছেন?”
বেশির ভাগ লোকই ঘাড় নেড়ে কথাটায় সম্মতি জানাল।
শুধু পরেশের ভাগ্নে কলকাতার সেই ফাজিল ছোঁকরা পল্টু বলে উঠল, “বজ্রাঙ্গবাবু, খুন হলেও কি আগে ইনফরমেশন দিয়ে নিতে হবে?”
বজ্রাঙ্গবাবুর কথার জবাবে কথা কয় এমন সাহসী লোক খুব কমই আছে। ছোঁকরার এলেম দেখে বজ্রাঙ্গবাবু খানিকক্ষণ হাঁ করে রইলেন। পরেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে হাতজোড় করে বলে, “আমার ভাগ্নে এটি। সদ্য কলকাতা থেকে এসেছে, আপনাকে এখনও চেনে না কিনা।”
একথায় বাঙ্গবাবুর বিস্ময় একটু কমল। বললেন, “তাই। বলল। কলকাতার ছেলে। তা ওহে ছোরা, খুনের কথাটা উঠল কিসে? কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ খুন-খুন করে গলা শুকোচ্ছ কেন?”
পল্টু ভালমানুষের মতো বলল, “খুনের কথা ভাবলেই আমার গলা শুকিয়ে যায় যে! তার ওপর অপঘাতে মরলে লোকে মরার পর ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেদিন রাত্রে–থাক, বলব না।”
বজ্রাঙ্গবাবু কঠোরতর চোখে পল্টুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কেউ যদি “সেদিন রাত্রে–” বলে একটা গল্প ফাঁদবার পরই “থাক, বলব না” বলে বেঁকে বসে তাহলে কার না রাগ হয়। বজ্রাঙ্গবাবুরও হল। গাঁক করে উঠে বললেন, “বলবে না মানে? ইয়ার্কি করার আর জায়গা পাওনি?”
পল্টু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “আপনারা বিশ্বাস করবেন না। বললে হয়তো হাসবেন। কিন্তু সেদিন রাত্রে–উরেব্বাস!”
বজ্রাঙ্গবাবু ধৈর্য হারিয়ে একজন সেপাইকে বললেন, “ছেলেটাকে জাপটে ধরো তো! তারপর জোরসে কাতুকুতু দাও।”
এতে কাজ হল। পল্টু তাড়াতাড়ি বলতে লাগল, “সেদিন রাত্রে আমি গয়েশবাবুকে দেখেছি।”
“দেখেছ? তাহলে সেটা এতক্ষণ বলোনি কেন?”
“ভয়ে। আপনাকে দেখলেই ভয় লাগে কিনা।”
একথা শুনে বজ্রাঙ্গবাবু একটু খুশিই হন। তাঁকে দেখলে ভয় খায় না এমন লোককে তিনি পছন্দ করেন না। গোঁফের ফাঁকে চিড়িক করে একটু হেসেই তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাত তখন ক’টা?”
“নিশুতি রাত। তবে ক’টা তা বলতে পারব না। আমার ঘড়ি নেই কিনা। মামা বলেছে বি-এ পাশ করলে একটা ঘড়ি কিনে দেবে। আচ্ছা দারোগাবাবু, একটা মোটামুটি ভাল হাতঘড়ির দাম কত?”