মৃদঙ্গবাবুকেও একবার জব্দ করেছিলেন গয়েশবাবু। হয়েছে। কী, গয়েশবাবুর লেজের কথা কানাঘুষোয় শুনে মৃদঙ্গবাবু প্রায়ই রাস্তাঘাটে তাঁর পিছু নিতেন। অবশ্য খুবই সন্তর্পণে এবং গোপনে। যদি হঠাৎ কখনও লেজটার কোনও আভাস-ইংগিত পাওয়া যায়। একদিন হরিহরবাবুর চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডায় দুজনে একসঙ্গেই যাচ্ছিলেন। অভ্যাসবশে মৃদঙ্গবাবু মাঝে-মাঝে গয়েশবাবুর লেজ খুঁজতে আড়চোখে চাইছেন। এমন সময় গয়েশবাবু হঠাৎ থমকে গিয়ে চাপা স্বরে বললেন, “মৃদঙ্গবাবু! আছে! আছে!”
“আছে?” বলে মৃদঙ্গবাবু স্থানকালপাত্র ভুলে “হুররে” বলে লাফিয়ে উঠলেন।
গয়েশবাবু তখন আরও চাপা স্বরে বললেন, “কাউকে বলবেন কথাটা।”
মৃদঙ্গবাবু আহ্লাদের গলায় বললেন, “আরে না, না। তবে একবারটি যদি চোখের দেখা দেখিয়ে দেন তবে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়।”
গয়েশবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “দেখাব? না, না, তাহলে সবাই টের পেয়ে যাবে। দেখানোর দরকার নেই। শুধু জেনে রাখুন, লোকটা এখানেই আছে।”
“লোকটা? লোকটা না লেজটা? ঠিক করে বলুন তো আর একবার গয়েশদা। ছেলেবেলায় একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলুম। সেই থেকে বাঁ কানে একটু কম শুনি।”
“লেজ!” গয়েশবাবু আকাশ থেকে পড়ে বলেন, “লেজ কোথায়? লেজের কথা বলিনি। সেই লোকটার কথা বলছি। সে-ই যে লোকটা।”
কিন্তু তখন মৃদঙ্গবাবুর কৌতূহল নিভে গেছে। কোনও লোক নিয়ে তাঁর কোনও আগ্রহ নেই। লোকেরা সব বেয়াদব, বেয়াড়া, বিচ্ছিরি। তবে হ্যাঁ, লেজওয়ালা কোনও লোক পেলে তাকে তিনি মাথায় করে রাখতে রাজী। মৃদঙ্গবাবু তাই নিস্তেজ গলায় বললেন, “কোন লোকটা?”
গয়েশবাবু মিটমিট করে একটু হাসছিলেন। বললেন, “সে-কথা পরে। কিন্তু আগে বলুন তো, লেজের কথাটা আপনার মাথায় এল কেন? কিসের লেজ?”।
মৃদঙ্গবাবু লজ্জা পেয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলেন, খোলাখুলি কথাটা বলাও যায় না। গয়েশবাবু চটে যেতে পারেন। তাই তিনি ভণিতা করতে লাগলেন, “আসলে কী জানেন গয়েশদা, কিছুদিন যাবৎ আমি লেজের উপকারিতা নিয়ে ভাবছি। ভেবে দেখলাম, লেজের মতো জিনিস হয় না। বেশির ভাগ জীবজন্তুরই লেজ আছে, শুধু মানুষের লেজ না থাকাটা ভারী অন্যায়। লেজ দিয়ে মশা মাছি তাড়ানো যায়, নিজের পিঠে সুড়সুড়ি দেওয়া যায়, লেজে খেলানো যায়, লেজ গুটিয়ে পালানো যায়। ভেবে দেখুন, আজ মেয়েদের কত এক্সট্রা গয়না পরার স্কোপ থাকত লেজ হলে।”
গয়েশবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “খুব খাঁটি কথা। তা আমি যে-লোকটার কথা বলছি, কী বলব আপনাকে, বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, সেই লোকটারও লেজ আছে। শুধু আছে নয়, সে রীতিমত আমাকে লেজে খেলাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে।”
মৃদঙ্গবাবু “অ্যাঁ?” বলে চোখ বিস্ফারিত করেন। বলেন কী দাদা, তাহলে কি উলটো বিবর্তন ঘটতে শুরু করল নাকি? জনে-জনে লেজ দেখা দিলে তো”
এরপর গয়েশবাবু আর কথা বাড়াতে চাননি। মৃদঙ্গবাবুর বিস্তর চাপাচাপিতেও না।
কিন্তু মৃদঙ্গবাবু খুব ভাবিত হয়ে পড়লেন। শুধু এই ছোট গঞ্জ-শহরেই যদি দুদুটো লেজওয়ালা লোকের আবির্ভাব ঘটে থাকে, তবে পৃথিবীতে না জানি আরও কত লক্ষ লোকের লেজ দেখা দিয়েছে এতদিনে। বিবর্তনের চাকা উলটো দিকে ঘোরে না বড়-একটা। তবে ইংরেজিতে একটা কথা আছে, হিস্টরি রিপিটস ইটসেলফ। সুতরাং কিছুই বলা যায় না। তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
লেজের কথা আর কিছু জানা যায় না।
তবে গয়েশবাবু একদিন সন্ধেবেলায় দাবা খেলার সময় ফুচুর জ্যাঠামশাইগঙ্গাগোবিন্দকে বলেছিলেন, “রুইতনটা দেখলেই বোঝা যায়।”
গঙ্গাগোবিন্দ গয়েশবাবুর একটা বিপজ্জনক আগুয়ান বোডড়কে গজ দিয়ে চেপে দিতে যাচ্ছিলেন। থেমে গিয়ে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, “রুই? তা কত করে নিল?”
“রুই নয়। রুইতন।”
গঙ্গাগোবিন্দ শশব্যস্তে দাবার ছকের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, “রুইতন? বলো কী? এতক্ষণ তবে কি আমরা বসেবসে তাস খেলছি? দাবা নয়? এ, সেটা এতক্ষণ বলোনি কেন?”
গয়েশবাবু একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “না, আমরা দাবাই খেলছি। কিন্তু রুইতনের কথাটা ভুলতে পারছি না।”
গঙ্গাগোবিন্দ দাবা খেলতে বসলে এতই মজে যান যে, দুনিয়ার কিছুই আর মনে থাকে না। খেলার পরেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে অনেকক্ষণ সময় লাগে। আর যতক্ষণ তা ফিরে না আসে, ততক্ষণ তিনি লোকের কথাবাতার অর্থ বুঝতে পারেন না, জল আর দুধের তফাত ধরতে পারেন না, তারিখ মাস বা দিন পর্যন্ত মনে পড়ে না তাঁর। তাই তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, “ভুলতে পারছ না! কী মুশকিল!”
গয়েশবাবু মোলায়েম স্বরে বললেন, “রুইতন বটে, তবে তাসের রুইতন নয়। একটা লোকের বাঁ হাতের তেলোয় মস্ত একটা রুইতন আছে। দেখলেই চিনবেন। পাঞ্জাব থেকে পিছু নিয়েছিল। মোগলসরাইতে চোখে ধুলো দিতে পেরেছিলাম। কিন্তু গন্ধ শুকে-শুকে ঠিক খুঁজে বের করেছে আমাকে।”
গঙ্গাগোবিন্দ চোখ বুজে বললেন, “আর একবার বলো। বুঝতে পারিনি।”
গয়েশবাবু আবার বললেন।
গঙ্গাগোবিন্দ চোখ খুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আজকাল চারদিকে ভাল-ভাল লোকগুলোর কেন যে মাথা বিগড়ে যাচ্ছে।”
গয়েশবাবু আর একটাও কথা বললেন না। শুধু একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
এখন গয়েশবাবু গায়েব হওয়ার পর সেইসব কথা সকলের মনে পড়তে লাগল।
৪. দারোগা বজ্রাঙ্গ বোস
পরদিন দারোগা বজ্রাঙ্গ বোস তদন্তে এলেন। খুবই দাপুটে লোক। লম্বা-চওড়া চেহারা। প্রকাণ্ড মিলিটারি গোঁফ। ভূত আর আরশোলা ছাড়া পৃথিবীর আর কাউকেই ভয় পান না। তিনি এ-অঞ্চলে বদলি হয়ে আসার আগে এখানে চোর আর ডাকাতদের ভীষণ উৎপাত ছিল। কেলো, বিশে আর হরি ডাকাতের দাপটে তল্লাট কাঁপত। গুণধর, সিধু আর পটলা ছিল বিখ্যাত চোর। এখন সেই কেলো আর বিশে বজ্রাঙ্গ বোসের হাত-পা টিপে দেয় দুবেলা। হরি দারোগাবাবুর স্নানের সময় গায়ে তেল মালিশ করে। গুণধর কুয়ো থেকে জল তোলে, সিধু দারোগাবাবুর জুতো বুরুশ করে আর পটলা বাগানের মাটি কুপিয়ে দেয়।