ঠিক এই সময়ে পাশের রাস্তা দিয়ে তিনটে ছোট বড় মূর্তি দৌড়ে এল। গোপাল ক্ষুর হাতে একটু আঁতকে উঠেছিল। মূর্তি তিনটে থেমে গেল। একজন মোটা গলায় পেঁচিয়ে উঠল, “গয়েশবাবু খু-উ-ন! গয়েশবাবু খু-উ-ন!” তারপর আবার দৌড়ে চলে গেল।
“গয়েশ খুন হয়েছে? অ্যাঁ!” ফুচুর জ্যাঠামশাই গঙ্গাগোবিন্দ হাঁ করে রইলেন। গয়েশ তাঁর দাবার পার্টনার ছিল যে!
নেপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে নাহয় হল। কিন্তু সুমন্তবাবুর আক্কেলটা দেখলেন। একটা গুহ্য খবর আস্তে আস্তে ভাঙছি, উনি হেঁড়ে গলায় পেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে চলে গেলেন।”
৩. গয়েশবাবুর লাশ
কিন্তু মুশকিল হল, গয়েশবাবুর লাশটা নদী থেকে তোলার পর দেখা গেল, সেটা মোটেই গয়েশবাবু বা আর কারও লাশ নয়। সেটা একটা গোড়াকাটা কলাগাছ। আর সতুবাবুদের গা-ছমছমে পোড়াবাড়িটার পিছনের জঙ্গলে-ছাওয়া বাগানে শিমুলগাছের ডালে যেটা ছিল, সেটাও গয়েশবাবুর মুণ্ডু নয়। ভাল গাছ বাইতে পারে বলে ফুফুকেই সবাই ঠেলে তুলেছিল গাছে। সে অনেক আগাছা, লতানে গাছ আর শিমুলের পাতার আড়াল ভেদ করে মগডালের কাছাকাছি পৌঁছতেই গোটাকয় মৌমাছি তেড়ে এসে হুল দিল। ফুচু বড় বড় চোখে চেয়ে দেখল, ডাল থেকে গয়েশবাবুর মুণ্ডু তার দিকে চেয়ে দাঁত খিচোচ্ছে না, বরং লম্বা দাড়িওলা শান্ত একটা মুখের মতো ঝুলে আছে একটা মৌচাক।
তাহলে গয়েশবাবুর হল কী?
লোকে গয়েশবাবুকে জানে অতি শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট মানুষ বলে। তিনি শান্ত লোক ছিলেন এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাঁর ব্যবহারও ছিল অতি শিষ্ট। কিন্তু তাঁর লেজ নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকেই বলে, “গয়েশবাবুর লেজ আছে। আমার ঠাকুদার নিজের চোখে দেখা। সন্ধেবেলা ঘরের দাওয়ায় নিরিবিলিতে বসে তিনি লেজ দিয়ে মশা তাড়ান।” আবার অনেকের ধারণা–লেজের কথাটা স্রেফ গাঁজা, ছেলেবেলায় খুব দুষ্ট ছিলেন বলে মাস্টারমশাইরা তাঁর লেজ কল্পনা করেছিলেন, সেই থেকে কথাটা চালু হয়ে গেছে।
কিন্তু এখন গয়েশবাবুও নেই, তাঁর লেজও দেখা যাচ্ছে না। বানর থেকে মানুষের যে বিবর্তন, সেই ধারায় একটা শূন্যস্থান আছে। নৃতত্ত্ববিদরা সেই শূন্যস্থানের নাম দিয়েছেন মিসিং লিংক। কলেজের বায়োলজির অধ্যাপক মৃদঙ্গবাবুর খুব আশা ছিল, গয়েশবাবুকে দিয়ে সেই মিসিং লিংক সমস্যার সমাধান হবে। হয়তো বা লেজবিশিষ্ট মানুষের প্রথম সন্ধান দিয়ে তিনিই নোবেল প্রাইজ পেয়ে যাবেন।
মৃদঙ্গবাবু প্রথমে খুনের খবরটা পেয়ে হায় হায় করে বুক চাপড়াতে লাগলেন। এমন কি এই শীতে গয়েশবাবুর লাশ তুলতে তিনিই প্রথম নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঝাঁপিয়ে পড়ার পর তাঁর খেয়াল হল, ওই যাঃ। তিনি যে সাঁতার জানেন না! যখন বিস্তর জল ও নাকানি-চোবানি খাওয়ার পর তাঁকে তোলা হল তখনও গয়েশবাবুর জন্য তিনি শোক করছিলেন। পরের জন্য মৃদঙ্গবাবুর এমন প্রাণ কাঁদে দেখে সকলেই তাঁর খুব প্রশংসা করছিল আজ। যাই হোক, ধড় বা মুণ্ডু কোনওটাই গয়েশবাবুর নয় জেনে মৃদঙ্গবাবু বাড়ি ফিরে গিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়েছেন।
সমস্যাটা মৃদঙ্গবাবুকে নিয়ে নয়, গয়েশবাবুকে নিয়ে। এই শান্তশিষ্ট এবং বিতর্কিত-লেজবিশিষ্ট মানুষটির নিকট-আত্মীয় বলতে কেউ নেই। পশ্চিম ভারতের কোথাও তিনি চাকরি করতেন। মেলা টাকা করেছেন। অবশেষে একটু বয়স হওয়ার পর দেশের জন্য প্রাণ কাঁদতে থাকায় চলে এসে পৈতৃক আমলের বাড়িটায় একাই থাকতে লাগলেন। খুব বাগানের শখ ছিল। জ্যোতিষবিদ্যে জানা ছিল। ভাল দাবা খেলতে পারতেন। ছোটখাটো ম্যাজিক দেখাতে পারতেন। তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি ছিল। তবে মাঝে-মাঝে কোনও লোককে দেখে অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলে ফেলতেন। কিন্তু অদ্ভুত শোনালেও কথাগুলির গুঢ় অর্থ আছে বলে অনেকের মনে বিশ্বাস আছে।
এলাকার বিখ্যাত ঢোলক বীর হল গোবিন্দ। তার ভাই জয়কৃষ্ণ ভাল ঢাক বাজায়। ফলে গোবিন্দর নাম হয়ে গেছে ঢোলগোবিন্দ আর জয়কৃষ্ণকে আদর করে ডাকা হয় জয়ঢাক বলে। সেবার ঈশানী কালীবাড়িতে বিরাট করে কালীপুজো হচ্ছে। কালীর গায়ে খাঁটি সোনার একশো আট ভরি গয়না। সকালবেলা দেখা গেল একটা মটরদানা হার আর একজোড়া রতনচূড় নেই। হৈ-চৈ পড়ে গেল চারধারে। দারোগা-পুলিশে ছয়লাপ। মণ্ডপের সকলকে ধরে সার্চ করা হল। পাওয়া গেল না। তোকজন কিছু সরে গেলে গয়েশবাবু ঢোলগোবিন্দের কাছে গিয়ে ভারী নিরীহ গলায় বললেন, “ঢোলের মধ্যেই গোল হে।” তারপর জয়ঢাকের কাছে গিয়ে এক গাল হেসে বললেন, “ঢাকেই যত ঢাকগুরগুর।” একথায় দুই ভাই খুব গম্ভীর আর মনমরা হয়ে গেল হঠাৎ। ঘণ্টা দুই বাদে ঈশানীকালীর সিংহাসনের পিছনে খোয়া-যাওয়া গয়না ফিরে এল। সকলেই বুঝল, গয়েশবাবুর কথা এমনিতে অর্থহীন মনে হলেও যার বোঝার সে ঠিকই বুঝেছে আর ভয় খেয়ে গয়নাও ফেরত দিয়েছে।
একদিন বাজারের রাস্তায় গয়েশবাবু কবি সদানন্দকে বলেছিলেন, “কাজটা ভাল করেননি।”
“কোন কাজটা?”
“কাজটা ঠিক হয়নি সদানন্দবাবু। এর বেশি আমি আর ভেঙে বলতে পারব না।”
গয়েশবাবুর একথায় সদানন্দ মহা মুশকিলে পড়ে আধবেলা ধরে আকাশ-পাতাল ভাবলেন। তারপর হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, আগের রাতে যে কবিতাটা লিখেছেন, তাতে এক জায়গায় আশীবিষের সঙ্গে কিসমিস মিল দিয়েছেন। মিলটা দেওয়ার সময় মনটায় খটকা লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু তখন ওটা গোঁজামিল বলে ধরতে পারেননি। গয়েশবাবুর ইংগিতে ধরতে পারলেন এবং তৎক্ষণাৎ কিসমিস কেটে সে-জায়গায় অহর্নিশ বসিয়ে কবিতার খাতা বগলে নিয়ে ছুটলেন গয়েশবাবুর বাসায়।