প্রচণ্ড শীত। তার ওপর মাঝে মাঝে ডিঙির গায়ে ঢেউ ভেঙে জল ছিটকে আসছে গায়ে। সুমন্তবাবু আপাদমস্তক কম্বল দিয়ে জড়িয়ে নিয়েছেন। পল্টু খোলের মধ্যে খানিক সেঁধিয়ে হিহি করে কাঁপছে।
ধীরে ধীরে সময় কেটে যেতে লাগল। জোয়ারের স্রোতটাও যেন ধীরে ধীরে কমে এল একটু।
সুমন্তবাবু বললেন, “শীতে জমে গেলাম রে পল্টু! আয়, একটু গা গরম করি।”
“কী ভাবে কাকু?”
“নৌকো বেয়ে।” বলে সুমন্তবাবু পারে নেমে খুঁটি থেকে ডিঙির দড়িটা খুলে দিয়ে উঠে বৈঠা হাতে নিলেন।
নৌকো সুমন্তবাবু ভালই চালান। স্রোত ঠেলে দিব্যি বার দুই খাঁড়ির এপার ওপার হলেন। তারপর বললেন, “নাঃ; আজ আর হতভাগা আসবে না।”
হঠাৎ চাপাস্বরে পটু বলল, “আসছে।”
“বলিস কী?” বলেই সুমন্তবাবু বৈঠা রেখে নৌকোর মধ্যেই গোটা দুই বৈঠকি দিয়ে নিতে গেলেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নৌকোটা বোঁ বোঁ করে চরকির মতো দুটো পাক খেল।
“বাবা গো!” পল্টু ভয় খেয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
সুমন্তবাবু চোখের পলকে আবার বৈঠা তুলে নৌকো সামাল দিয়ে বললেন, “কোথায় রে? কই?”
“আপনি সব গণ্ডগোল করে দিচ্ছেন কাকু। ওই তো দূরে। ওই যে!”
বাস্তবিকই কিছু দূরে একটা কালো বস্তুকে জলে ভেসে আসতে দেখা গেল।
সুমন্তবাবু সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোর গলা শুনেছে?”
পল্টু ফিস ফিস করে বলল, “কে জানে? তবে বাতাস উল্টোদিকে বইছে। নাও শুনতে পারে।”
“জয় মা।” বলে কপালে বারকয়েক হাত ঠেকালেন সুমন্তবাবু।
নৃসিংহ-অবতার নৌকোর ভেলকি দেখাতে পারে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছিল, ছোট্ট নৌকোটা তীরের মতো গতিতে ছুটে আসছে। খাঁড়ির স্রোত কমলেও যা আছে তাও বেশ তীব্র। সেই স্রোত ঠেলে ওরকম গতিতে চলা খুব সোজা কাজ নয়।
পল্টু বলল, “আসছে কাকু! এসে গেল।”
“ও বাবা! তাহলে আর দুটো বৈঠকি দিয়ে নেব নাকি?”
“সর্বনাশ! ও কাজও করবেন না। নৌকো বানচাল হয়ে যাবে।”
সুমন্তবাবু “জয় মা, জয় মা” বলে বিড়বিড় করতে লাগলেন। বিপরীত দিক থেকে নৌকোটা বিশ হাতের মধ্যে চলে এল। বৈঠার ছলাত ছলাত শব্দও পাওয়া যাচ্ছিল।
পল্টু জিজ্ঞেস করল, “কাকু, এবার কী করবেন?”
চিন্তিত সুমন্তবাবু বললেন, “তাই তো ভাবছি। একটা বন্দুক থাকলে–”
“যখন নেই তখনকার কথা ভাবুন।”
“লাঠিটা দে।”
“লাঠি দিয়ে নাগাল পাবেন না।”
“তাহলে তুই একটা বৈঠা জলে ডুবিয়ে নৌকোটা সামলে রাখ। আমি আর একটা বৈঠা দিয়ে ঘা কতক দিই লোকটাকে।”
“পারবেন?”
“জয় মা।” বলে সুমন্তবাবু বৈঠা নিয়ে খাড়া হলেন। কিন্তু পল্টুর অনভ্যস্ত হাতে নৌকোটা স্থির থাকছে না। টালমাটাল হয়ে যাচ্ছে। সুমন্তবাবু ঝড়াক করে খোলের মধ্যে পড়ে গেলেন। আবার উঠলেন।
তা করতে করতে নৌকোটা পাল্লার মধ্যে এসে পড়ল। কিন্তু নৃসিংহ-অবতার খুবই বুদ্ধিমান। একটা নৌকো যে খাঁড়ির মুখ আগলাচ্ছে তা লক্ষ করেই আচমকা নিজের নৌকোটাকে চোখের পলকে দশ হাত তফাতে নিয়ে ফেলল সে। তারপর নদীর দিকে প্রাণপণে এগোতে লাগল।
সুমন্তবাবু বুঝলেন, সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে। পল্টুর হাত থেকে বৈঠাটা টেনে নিয়ে তিনি দু হাতে প্রাণপণে বাইতে লাগলেন। টপটপ করে ঘাম ঝরতে লাগল তার এই শীতেও। ফিসফিস করে বললেন, “হ্যাঁ, একেই বলে একসারসাইজ! এই হল একসারসাইজ!”
নৃসিংহ-অবতারের নৌকোটার কাছাকাছি এগিয়ে গেল সুমন্তবাবুদের ডিঙি। এই জায়গায় জলের স্রোত এখনও ভীষণ। দুটো ডিঙির কোনওটাই তেমন এগোতে পারছে না। তবু তার মধ্যেই নৃসিংহ-অবতারের ডিঙি কয়েক হাত এগিয়ে যেতে পেরেছে এবং আরও এগিয়ে যাচ্ছে!
সুমন্তবাবু চেঁচালেন, “খবরদার! থামো বলছি! নইলে গুঁড়িয়ে দেব!”
নৃসিংহ-অবতার কোনও জবাব দিল না। কিন্তু দু হাতে চমৎকার বৈঠা মেরে নৌকোটাকে প্রায় নাগালের বাইরে নিয়ে ফেলল।
“তবে রে?” বলে সুমন্তবাবু দুই হাতে প্রায় ঝড় তুলে ফেললেন বৈঠার ঘায়ে। ছোট্ট ডিঙিটা ঢেউয়ের ওপর দিয়ে দুটো লাফ মেরে ব্যাংবাজির মতো ছিটকে নৃসিংহ-অবতারের নৌকোকে ছুঁয়ে ফেলল। সুমন্তবাবু সঙ্গে সঙ্গে একটা বৈঠা তুলে দড়াম করে বসালেন গলুইয়ে বসা লোকটার মাথায়।
কিন্তু কোথায় মাথা। চতুর লোকটা চোখের পলকে নৌকোটাকে একটা চরকিবাজি খাইয়ে ঘুরিয়ে নিয়েছে। বৈঠা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সুমন্তবাবু টাল সামলাতে না পেরে গুপুস করে জলে গিয়ে পড়লেন।
পটু নিজের বিপদ আন্দাজ করে আগে থেকেই তৈরি ছিল। সুমন্তবাবুর সঙ্গে নৌকোয় চড়া যে কতটা বিপজ্জনক, তা সে অনেকক্ষণ আগেই বুঝে গেছে। সুতরাং নৃসিংহের নৌকোর গলুইতে তাদের গলুই ঠেকতেই সে টুক করে ওই নৌকোয় লাফিয়ে চলে গেছে। নৃসিংহ তখন নৌকো সামলাতে ব্যস্ত। তাই দেখেও তেমন কিছু করতে পারল না।
পল্টু দেখল, তাদের ডিঙিটা স্রোতের মুখে নক্ষত্ৰবেগে ওলটপালট খেতে খেতে ভেসে যাচ্ছে। তবে সুমন্তবাবু বীর-বিক্রমে সাঁতার দিয়ে আসছেন।
মুখে সিংহের মুখোশ পরা লোটা একটা বৈঠা তুলল। সুমন্তবাবুর মাথাটাই তার লক্ষ্য সন্দেহ নেই। পল্টু আর দেরি করল না। একটা ডাইভ দিয়ে সে সোজা নৃসিংহের কোলে গিয়ে পড়ল। তারপর দুই হাতে চালাতে লাগল দমাদম ঘুষি।
কিন্তু পল্টুর ঘুষিতে কাবু হওয়ার লোক নৃসিংহ নয়। হাতের এক ঝটকায় পল্টুকে ছিটকে ফেলে লোকটা আবার বৈঠা তুলে চোখের পলকে সুমন্তবাবুর মাথা লক্ষ করে চালাল। কিন্তু সুমন্তবাবু এবার খুব বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে টুক করে ডুব দিলেন।