কাঠুরিয়া মাথা নেড়ে বলল, “তোমার কথা তারা বিশ্বাস করবে। কারণ আমার ধারণা, মৃদঙ্গবাবুও সেই মুখোশধারীর পাল্লায় পড়েছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই পুলিশকে জানিয়েছেন।”
“তাহলে উপায়?”
“কোনও উপায় দেখছি না। কয়েক ঘণ্টার জন্য পাহারার কাজে ফাঁক পড়বেই।”
হঠাৎ সুমন্তবাবু একটা হুংকার দিলেন, “না, পড়বে না।”
কাঠুরিয়া অবাক হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে বলল, “তার মানে?”
“আমি পাহারা দেব। কী করতে হবে শুধু বলুন।”
কাঠুরিয়া একটু হাসল। বলল, “কাজটা খুব শক্ত, ভীষণ শক্ত। তাছাড়া আপনার বাড়ির লোকও তো আপনার জন্য ভাবছেন।”
সুমন্তবাবু ম্লান মুখে বললেন, “তা ভাবছে বটে। কিন্তু আমার বাড়ি ফেরার উপায় নেই। গয়েশের বাড়িতে আনঅথরাইজড অনুপ্রবেশের দরুন বজ্রাঙ্গ আমাকে ধরবেই। আমাদের বংশে কেউ কখনও পুলিশের খাতায় নাম লেখায়নি মশাই। তার চেয়ে বরং গুণ্ডা বদমাসদের সঙ্গে লড়াই করে জীবন বিসর্জন দেওয়াও শ্রেয়। না, আমিই পাহারা দেব। কী করতে হবে শুধু বলুন।”
পল্টুর বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। সেও বলে উঠল, “আমিও বাড়ি ফিরব না। পাহারা দেব।”
কাঠুরিয়া চিন্তিতভাবে সুমন্তবাবুকে বলে, “আপনি আর পল্টু দুজনের কারওই এসব বিপজ্জনক কাজে অভিজ্ঞতা নেই। যদি শেষ অবধি আপনাদের কিছু হয়?”
সুমন্তবাবু খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা বৈঠক দিয়ে বুকডন মারতে মারতে বললেন, “মরার চেয়ে বেশি আর কী হবে মশাই?”
কাঠুরিয়া বলে, “মরলেই তো হবে না, কাজটাও উদ্ধার করা চাই।”
“কাজটার কথাই বলুন। আমাদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে না।”
কাঠুরিয়া জিজ্ঞেস করল, “আপনি মোটরবোট চালাতে পারেন?”
সুমন্তবাবু বললেন, “না, তবে নৌকো বাইতে পারি।”
“তাহলেও হবে। আপনি নদী আর ঝিলের মাঝখানকার খাঁড়িটা নিশ্চয়ই চেনেন!”
“খুব চিনি মশাই, এখানেই তো জীবনটা কাটল।”
কাঠুরিয়া বলল, “লোকটা ওই খাড়ি দিয়ে নদীতে গিয়ে পড়বে। নদীতে পড়লে তাকে ধরা মুশকিল হবে। সে বোধহয় খুবই ভাল নৌকো চালায়।”
“লোকটা যাবে কোথায়?”
“লোকটা নদীর স্রোতে পড়লে অনেকদূর অবধি ভাঁটিতে চলে যাবে। তারপর সম্ভবত কোনও মোটরলঞ্চ বা ছোট্ট স্টিমার তাকে তুলে নেবে।”
“আপনি তাহলে পুরো ষড়যন্ত্রটাই জানেন?”
“ঠিক জানি না। তবে আন্দাজ করছি। গয়েশবাবুকে খুন করার পিছনে উদ্দেশ্য একটাই। লোকজনকে বিভ্রান্ত করে দেওয়া। সকলের মনোযোগ এখন গয়েশবাবুর দিকে। আজ সারা রাত ধরে জেলেরা জলায় তাঁর লাশ খুঁজবে। সেই ফাঁকে একটা ছোট্ট নৌকো খাড়ি বেয়ে নদীতে পড়ল কিনা কে অত নজর রাখে! আর রাখবেই বা কেন? কিন্তু লোকটা জানে, আর কেউ নজর না রাখলেও আমরা রাখছি। তাই আমাদের সরিয়ে দেওয়ার চমৎকার একটা প্ল্যান করেছে সে। এখন শুধু নজর রাখছে কখন পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যায়।”
সুমন্তবাবু হঠাৎ বললেন, “জলপথেই বা সে পালাবে কেন? স্থলপথও তো আছে। ট্রেনে উঠে যদি পালায়?”
“তাহলে তার লাভ নেই। জলপথে যত সহজে স্বদেশের সীমা ডিঙোনো যায় স্থলপথে তত নয়। তা ছাড়া স্থলপথে নজর রাখারও লোক আছে। কিন্তু সে সেদিক দিয়ে পালাবে না, নিশ্চিন্ত থাকুন। ওই খড়িটাই তার একমাত্র পথ। আমাদের একটা ডিঙি নৌকোও আছে। আপনি আর পটু সেটা নিয়ে খাঁড়ির মুখটা পাহারা দেবেন, পারবেন?”
“পারব। কিন্তু লোকটাকে চিনব কী করে?”
“সম্ভবত তার মুখে এবারও সিংহের মুখোশ থাকবে। যদি তা না থাকে তবে কী করবেন তা বলতে পারব না। তবে নজর রাখবেন। ওই বোধহয় পুলিশের নৌকো এল।”
বাস্তবিকই দূরে অনেক লোকের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। জঙ্গল ভেঙে ভারী পায়ের এগিয়ে আসার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।
কাঠুরিয়া উঠে পড়ল। বলল, “ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাঁ দিকে এগিয়ে যান। দশ মিনিট হাঁটলেই খাঁড়ি।”
কাঠুরিয়া কুলুঙ্গি থেকে একটা টর্চ আর একটা বেতের লাঠি নামিয়ে সুমন্তবাবুকে দিয়ে বলল, “পল্টুকে দেখবেন।”
“ঠিক আছে। চলি।”
সুমন্তবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি-কি-মরি করে বাঁ দিকে হাঁটতে লাগলেন। সঙ্গে পল্টু। পিছনে পুলিশের তীব্র টর্চের আলো জঙ্গল ভেদ করে এদিকে-সেদিকে পড়ছে। দুজনে আরও জোরে হাঁটতে থাকে।
জঙ্গলের এবড়ো-খেবড়ো জমিতে টক্কর খেতে খেতে দুজনে খাঁড়ির ধারে পৌঁছে গেল। নদীতে ভরা জোয়ার। খাঁড়ি দিয়ে তীব্র স্রোত হুহুংকারে ঝিলের মধ্যে ঢুকছে। সেই স্রোতের ধাক্কায় মোচার খোলার মতো একটা ডিঙি নৌকো দোল খাচ্ছে তীরে। দুজনে নেমে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে ডিঙিটায় উঠে পড়ল।
“জয় দুগ! জয় দুর্গতিনাশিনী!” বলে একটা হুংকার ছাড়লেন সুমন্তবাবু।
পল্টু সতর্ক গলায় বলল, “কাকাবাবু! আস্তে। বজ্রাঙ্গবাবু শুনতে পেলে–”
সুমন্তবাবু ভয় খেয়ে তাড়াতাড়ি দু হাত জড়ো করে কপালে আর বুকে ঘন ঘন ঠেকাতে ঠেকাতে বিড়বিড় করে বললেন, “জয় বজরঙ্গবলী। জয় রাম। জয় অসুরদলনী।”
দুজনে চুপ করে বসে রইলেন নৌকোয়। কুয়াশা আজ বেশ পাতলা। তার ভিতর দিয়ে দূরে দূরে জেলে-নৌকোর বহু আলো দেখা যাচ্ছে। এখনও গয়েশবাবুর লাশের খোঁজ চলছে।
খাঁড়ির মুখ পাহারা দেওয়া এমনিতে শক্ত নয়। মাত্র পঞ্চাশ হাতের মতো চওড়া জায়গাটা। তবে এখন জোয়ারের সময় জলের তোড় কিছু বেশি। কোনও নৌকোকে নদীতে যেতে হলে বেশ কসরত করতে হবে। কিন্তু দুজনেই জানে, দুনম্বর মুখোশধারী নৌকো বাওয়ায় দারুণ ওস্তাদ লোক। এই স্রোত ঠেলে নৌকো নিয়ে নদীতে পড়তে তার বিশেষ অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া অন্ধকার মতো আছে, কুয়াশা আছে। মুখোশধারী নিশ্চিত আলো জ্বেলে আসবে না। কাজেই দুজনে খুব তীক্ষ্ণ চোখে নজর রাখতে লাগল।