“কী হবে?”
“মুখোশধারী কিছুক্ষণের জন্য আমাদের এখান থেকে সরাতে চাইছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যও যদি আমাদের এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সেই ফাঁকে সে মস্ত একটা কাজ হাসিল করে নেবে।”
“কী কাজ হাসিল করবে?”
“সেইটে জানার জন্যই তো আমরা এখানে বেশ কিছুদিন হয় থানা গেড়ে বসে আছি।”
“পুলিশ কি আপনাদের ধরবেই?”
কাঠুরিয়া আবার হাসল, “তাই তো মনে হচ্ছে।”
“আমি ফিরে গিয়ে না হয় কিছু বলব না।”
কাঠুরিয়া মাথা নেড়ে বলল, “তুমি না বললে কী হয়! দ্বিতীয় মুখোশধারী বোকা লোক নয়। সে যা করেছে তা দিনের আলোতেই করেছে। নিজেকে খুব একটা গোপন রাখেনি। জলায় সর্বদাই জেলেদের নৌকো ঘোরে। তাদের চোখে পড়বেই। তুমি না বললেও তারা বলে দেরে। সুতরাং পুলিশ যে আসবেই তাতে সন্দেহ নেই।”
হঠাৎ আবার আগেকার মতোই দূরে ঘুঘুর ডাক শোনা গেল। লোকটা উৎকৰ্শ হয়ে শুনল। তারপর পল্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এসো।”
পল্টু উঠে পড়ল। বলল, “কিছু পাওয়া গেছে ওই দ্বীপে?”
“মনে তো হচ্ছে। চলো দেখি।”
খাঁড়ির মুখে এসে তারা দেখে, মুখোশধারী মোটরবোট থেকে পাঁজাকোলা করে একটা লোককে নামিয়ে আনছে। লোকটাকে দেখে পল্টু চেঁচিয়ে উঠল, “আরে! এ যে সান্টুর বাবা–“
কাঠুরিয়া বলল, “চেনো তাহলে!”
“খুব চিনি।”।
মুখোশধারী সুমন্তবাবুকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “একটুর জন্য লোকটাকে সাপে কামড়ায়নি। কিন্তু লোকটা একটু অদ্ভুত। অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল, হাতে একটা লাউডগা সাপ বাইছিল। সাপটাকে তাড়িয়ে মুখে চোখে জলের ঝাঁপটা দিতেই উঠে বসল। তারপর কথা নেই বার্তা নেই দুম করে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুষি চালাতে লাগল। তাই বাধ্য হয়ে আমি লোকটার চোয়ালে একটা ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দিই। তারপর নিয়ে আসি।”
কাঠুরিয়া পল্টুর দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে, “বুঝলে?”
“না।” বলেই পল্টু আবার তাড়াতাড়ি বলল, “বুঝেলে? আপনার বন্ধুকে সুমন্তবাবু আমার মতো সেই দ্বিতীয় মুখোশধারী বলে মনে করেছিল।”
“ঠিক বলেছ। দু নম্বর মুখোশধারী খুব কাজের লোক।”
পল্টু উদ্বেগের সঙ্গে বলে, “আচ্ছা, গয়েশবাবুকেও কি মুখোশধারীই সরিয়ে দিয়েছে?”
“খুব সম্ভব।”
“উনি কি বেঁচে আছেন?”
“সেটা বলা শক্ত।”
“লোকে বলছে ওঁকে খুন করা হয়েছে।”
কাঠুরিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সেটাই স্বাভাবিক। গয়েশবাবুর ঘটনাটাই সব গণ্ডগোল পাকিয়ে দিয়েছে।”
কাঠুরিয়ার মুখোশধারী বন্ধু খাঁড়ি থেকে একটা মগে করে জল এনে সুমন্তবাবুর মুখে চোখে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই সুমন্তবাবুর চোখ পিটপিট করতে লাগল।
কাঠুরিয়া মৃদুস্বরে বলল, “বিনয়, তুমি সামনে থেকো না। তোমাকে দেখলেই আবার ভায়োলেন্ট হয়ে উঠবে।”
মুখোশধারী বোধহয় মুখোশের আড়ালে একটু হাসল। তারপর নেমে গিয়ে তার মোটরবোটের মুখ ঘুরিয়ে আবার জলায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুমন্তবাবু চোখ পিটপিট করে কাঠুরিয়াকে একটু দেখে নিয়েই হঠাৎ “তবে রে!” বলে একটা হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলেন। কাঠুরিয়া একটুও নড়ল না। সুমন্তবাবু দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে নিজেই বসে পড়লেন। তারপর হঠাৎ পটাং পটাং করে কয়েকটা বৈঠক এবং বুকডন দিয়ে নিতে লাগলেন।
এবার আত্মপ্রকাশ করা বিধেয় ভেবে পটু এগিয়ে গিয়ে মিষ্টি করে বলল, “কাকাবাবু, কোনও ভয় নেই। ইনি আমাদের শত্রু নন।”
সুমন্তবাবু একটা বুকডনের মাঝখানে থেমে হ করে পল্টুর দিকে চেয়ে রইলেন।
কাঠুরিয়া তাঁকে ধরে তুলল। তারপর বলল, “আমি কখনও মারপিট করিনি। আপনি মারলে আমার খুব ব্যথা লাগত। আমি তো শত্রু নই, বন্ধু।”
৯. ফের সেই খোড়ো ঘরটায়
ফের সেই খোড়ো ঘরটায় ফিরে এল তারা। সঙ্গে সুমন্তবাবু। কাঠুরিয়া তাঁকে শুকনো একটা ধুতি আর একখানা কম্বল দিল গায়ে দেওয়ার জন্য। কুলুঙ্গি থেকে নামিয়ে চিড়ে, গুড়, মর্তমান কলা দিয়ে খাওয়াল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই ঘটনাটা বলে গেলেন সুমন্তবাবু।
কাঠুরিয়া চুপ করে শুনল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “মৃদঙ্গবাবুর কী হল সে খবর কি জানেন?”
সুমন্তবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “না। বোধহয় পুলিশে ধরেছে।”
কাঠুরিয়া চুপ করে ভাবতে লাগল। বাইরে সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। পাখিরা ফিরে আসছে নিজেদের বাসায়। তাদের কিচির-মিচির শব্দে বনভূমি মুখর। সন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই ঠাণ্ডা বাড়তে লাগল। জলার জল ছুঁয়ে উত্তুরে বাতাস এল হু হু করে। শীতে সুমন্তবাবু আর পল্টু কাঁপতে লাগল। কিন্তু কাঠুরিয়া নির্বিকার।
অন্ধকার হয়ে আসার পর কাঠকুটো জ্বেলে ঘরের মধ্যে একটা চমৎকার আগুন তৈরি করল কাঠুরিয়া। তারপর পল্টুকে বলল, “আমার বন্ধু একটা জরুরি কাজ সেরে আসতে গেছে। তোমাকে সে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারত, কিন্তু তার আর দরকার নেই। খবর পেয়েছি, পুলিশ এখানে আসছে। তারা এলে তুমি তাদের সঙ্গেই ফিরে যেতে পারবে।”
“আর আপনি?”
কাঠুরিয়া একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার পালিয়ে যাওয়ার পথ আছে। কিন্তু পালিয়ে লাভ নেই।”
“কেন?”
“পালালে পুলিশের হাত এড়াতে পারব বটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে পাহারার কাজেও ফাঁক পড়বে। দু নম্বর মুখোশধারী আমাকে বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দিয়েছে।”
“কেন, আমি পুলিশকে বলব যে, এ কাজ আপনার বন্ধু করেনি।”