পল্টুর ভিতর থেকে আপনাআপনিই একটা আতঙ্কের চিৎকার উঠে আসছিল। মুখে হাতচাপা দিয়ে সে চিৎকারটাকে আটকাল। একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে দেখল, মুখোশধারী কাঠুরিয়ার সঙ্গে কী যেন কথা বলছে।
খুব সামান্যক্ষণই কথা বলল তারা। মুখোশধারী আবার মোটরবোটে ফিরে গেল। তারপর বোটের মুখ ঘুরিয়ে জল কেটে চলে গেল কোথায়। বোটটার মোটরে খুব সামান্য একটু শব্দ হচ্ছিল। বোধহয় খুবই দামি মোটরবোট।
কাঠুরিয়া কয়েক সেকেন্ড মোটরবোটটার গমনপথের দিকে চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে ফিরে আসতে লাগল।
আর এবারই হঠাৎ ভয় পেল পল্টু। দারুণ ভয়। সে বুঝতে পারল, তার বিপদ ঘনিয়ে আসছে। সে মুখ ঘুরিয়ে দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োতে লাগল। কোথায় যাচ্ছে জানে না। কী হবে জানে না। শুধু মনে হচ্ছে, পালানো দরকার। এক্ষুনি পালানো দরকার।
কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে দৌড়োনো সহজ নয়। পদে পদে অজস্র বাধা, কাঁটাগাছ, লতা, ঝোঁপঝাড়, কী নেই। বার দুই পড়ে গেল পল্টু।
পিছন থেকে একটা হেঁড়ে গলার হাঁক শোনা গেল হঠাৎ, “পল্টু! পল্টু! পালিও না। ভয় নেই।”
পল্টু আরও আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে দৌড়োতে গিয়ে দিক হারিয়ে ফেলল। হঠাৎ দেখল সামনে তার পথ আটকে সেই কাঠুরিয়া দাঁড়িয়ে।
পল্টুর গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। নিষ্পলক আতঙ্কিত চোখে চেয়ে রইল লোকটার দিকে।
কাঠুরিয়া একটা হাত বাড়িয়ে বলল, “অত ভয় পেলে কেন? মুখোশধারীকে দেখে? ওকে ভয়ের কিছু নেই। যে তোমাকে এখানে এনেছে, সে ও লোকটা নয়।”
“তাহলে ও কে?”
“ও আমার বন্ধু। এসো, কিছু ভয়ের নেই।”
“আমি যাব না।”
লোকটা হেসে ফেলল। সরল হাসি। বলল, “তোমার মতো ছোট্ট একটু ছেলেকে ইচ্ছে করলেই তো আমি মেরে ফেলতে পারি, যদি আমার সেই মতলব থাকে। তাই না? তবু যখন মারছি
তখন নিশ্চয়ই আমার সে মতলব নেই।”
“তাহলে?”
“তাহলে কিছু নয়। আমার সঙ্গে এসো, সব বলছি।”
পল্টু লোকটার হাত ধরল। লোকটা পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে যেতে তাকে বলল, “এই দ্বীপটার একধারে নদী, অন্যধারে বড় ঝিল। নদী থেকে ঝিলে ঢুকবার পথ আছে। আমি এখানে সেই পথটা পাহারা দিই।”
“কেন?”
“লক্ষ করি কারা ওই পথে যাতায়াত করে।”
“আর ওই মোটরবোটের লোকটা?”
“ও লোকটাও পাহারা দেয়। সারাক্ষণ তো একজনের পক্ষে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। ও আমাকে সাহায্য করে।”
“আপনি তাহলে কাঠুরিয়া নন?”
“কাঠুরিয়াও বটে। তবে শুধু কাঠুরিয়া নই।”
“আপনি কি পুলিশের লোক?”
“অনেকটা তাই।”
“পাহারা দেন কেন?”
“কিছু দুষ্টু লোক এই পথ দিয়ে আনাগোনা করে।”
“ওই মুখোশওলা লোকটা কি সত্যিই আমাকে এখানে আনেনি?”
“না। ও তোমাকে চেনেও না। তবে যে তোমাকে এখানে এনেছে সে খুব চালাক লোক।”
“কেন?”
“সে জানে যে, তুমি মরবে না। শহরে ফিরেও যাবে। গিয়ে বলবে যে, একজন সিংহের মুখোশ-পরা লোক তোমাকে চুরি করে এনেছিল। তখন দোষটা গিয়ে পড়বে আমার ওই বন্ধুটির কাঁধে। কারণ এই অঞ্চলে যে-সব কাঠুরিয়া, জেলে আর মউলি যাতায়াত করে তারা সবাই আমাকে আর আমার বন্ধুকে চেনে, তারা জানে আমার বন্ধু একটা মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়।”
“আপনার বন্ধু মুখোশ পরে কেন?”
“এমনিতে কোনও দরকার নেই। খানিকটা শখ বলতে পারো। আর একটা উদ্দেশ্য হল, যেসব দুষ্ট লোক এখান দিয়ে আনাগোনা করে তারা যাতে ওকে চিনে না রাখতে পারে।”
“কিন্তু মুখোশ দেখলে তো লোকের সন্দেহ আরও বাড়বে।”
কাঠুরিয়া খুব হেঃ হেঃ করে হেসে উঠল। বলল, “বাঃ! তোমার তো খুব বুদ্ধি! কথাটা ঠিক বলেছ। তবে আমার ওই বন্ধুটির মুখটা দেখতে বিশেষ ভাল নয়। ছেলেবেলায় আগুনে পুড়ে মুখটা একটু বীভৎস হয়ে গেছে। ফলে ও মুখোশ ছাড়া বেরোতে চায় না। ওর অবশ্য নানারকম মুখোশ আছে। তবে সিংহের মুখোশটাই ও সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে।”
তারা খোড়ো ঘরটার কাছে পৌঁছে গেল হাঁটতে হাঁটতে।
কাঠুরিয়া ঘরে ঢুকে বলল, “চুপচাপ বসে বিশ্রাম নাও। আমার বন্ধুটি ফিরে এলে তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে।”
“আপনার বন্ধু কোথায় গেল?”
“একজন জেলে আমার বন্ধুকে খবর দিয়েছে, সিংহের মুখোশ-পরা একটা তোক একটা নৌকোয় করে জলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু আগেও তাকে দেখা গেছে পশ্চিম ধারের একটা দ্বীপের কাছে। আমাদের মনে হয়, লোকটা ওখানেই কোনও কীর্তি করে এসেছে। আমার বন্ধু সেখানে গেল দেখে আসতে।”
“তাহলে মুখোশধারী দু নম্বর লোকটা কে?”
“সে নিশ্চয়ই আমাদের বন্ধু নয়।”
“আপনি তাকে চেনেন না?”
“কী করে চিনব? তবে আমার ধারণা, লোকটা খুব অচেনাও নয়।”
“সে এসব করছে কেন?”
“বললাম যে, সে আমাদের বিপদে ফেলতে চায়। পুলিশ যখনই খবর পাবে যে, একজন মুখোশধারী একটা বাচ্চা ছেলেকে গুম করে এখানে এনে ফেলে রেখে গিয়েছিল, তখনই খোঁজখবর এবং তল্লাশ শুরু হবে। আমাদের হদিস পেতে পুলিশের মোটেই দেরি হবে না। তারা এসে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে।”
“কিন্তু আপনারাও তো পুলিশের লোক!”
“তা অনেকটা বটে। কিন্তু আমরা সাধারণ পুলিশ নই। আমাদের কাছে আইডেনটিটি কার্ড বা কোনও প্রমাণপত্র থাকে না। কাজেই ধরতে এলে প্রমাণ করতে পারব না যে, আমরা অপরাধী নই।”
“তাহলে কী হবে? আপনাদের জেল হবে?”
কাঠুরিয়া হেসে মাথা নেড়ে বলল, “তা অবশ্য হবে না। ধরা পড়ার পর আমরা আমাদের হেড কোয়ার্টারে ব্যাপারটা জানাব। সেখান থেকে আমাদের আইডেনটিফাই করা হলে পুলিশ আমাদের ছেড়েও দেবে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে যাবে।”