পল্টু কুড়ল দুটোর একটা হাতে তুলে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল, মনে হয়, ঘরে যে থাকে সে কাঠুরিয়াই। তবে আত্মরক্ষার জন্য হাতের কাছে কুড়লটা রাখা ভাল।
তক্তপোশটার ওপর বসে পল্টু পকেট থেকে আর একটা পেয়ারা বার করে খেতে লাগল।
কোথাও কোনও শব্দ হয়নি! আচমকাই দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।
পল্টু চিৎকার করার জন্য হাঁ করেছিল। কিন্তু শব্দ বেরোল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটা দৈত্য বিশেষ। তালগাছের মতো ঢ্যাঙা, বিপুল স্বাস্থ্য, দুই ঘন ভূর নীচে কঠিন একজোড়া চোখ।
কয়েকটা মুহূর্তকে যেন কত যুগ বলে মনে হচ্ছিল পল্টুর কাছে।
হঠাৎ লোকটা খুব নরম ভদ্র গলায় বলল, “ভয় পেও না। তুমি কে?”
পল্টু শ্বাস ছেড়ে কাঁপা গলায় বলল, “আমি পল্টু।”
“শহরে থাকো?”
“হ্যাঁ।”
“কার বাড়ি?”
“পরেশ রায় আমার মামা।”
লোকটা বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। গায়ে একটা হাতকাটা জামা, পরনে ধুতি, পায়ে টায়ার কেটে বানানো চপ্পল। লোকটার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল পল্টু।
লোকটা হাতের টাঙ্গি গোছের জিনিসটা বেড়ার গায়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বলল, “এখানে এলে কী করে? নৌকোয়?”
“আমি ইচ্ছে করে আসিনি। একটা মুখোশধারী লোক আমাকে এখানে এনে ছেড়ে দিয়ে গেছে।”
লোকটা অবাক হয়ে বলল, “ঘটনাটা কি আমায় খুলে বলবে?”
পল্টুর ভয় কেটেছে একটু। লোকটার চেহারা যেমন, স্বভাব হয়তো তেমন খারাপ নয়। সে ধীরে ধীরে বলতে লাগল।
আগাগোড়া দরজার গায়ে একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে লোকটা সব শুনল। কোনও কথা বলল না। পল্টুর গল্প শেষ হওয়ার পর মিনিট দুয়েক চুপ করে কী ভেবে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গয়েশবাবুর সঙ্গে আগের রাতে কি সত্যিই তোমার দেখা হয়েছিল?”
পল্টু মাথা নেড়ে বলল, “হয়েছিল। উনি আমার কাছে এসেছিলেন।”
ভ্রু কুঁচকে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“একটা জিনিস আমাকে রাখতে দিতে এসেছিলেন।”
“জিনিসটা কী?”
“কাগজে জড়ানো একটা প্যাকেট। আমি দোতলার ঘরে থাকি। মাঝরাতে আমার জানালায় ঢিল পড়ে। আমি জানালা খুলে দেখি, নীচে উনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে হাতছানি দিয়ে নীচে ডাকলেন। আমি নীচে গিয়ে দরজা খুলতেই উনি প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘খুব সাবধানে এটা তোমার কাছে লুকিয়ে রেখো। আমি ক’দিন পরে এসে নিয়ে যাব।”
“তুমি প্যাকেটটা খুলেছিলে?”
“না। গয়েশবাবুর সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। উনি আমাকে বিশ্বাস করতেন।”
লোকটা আবার একটু ভেবে নিয়ে বলল, “প্যাকেটটা কি খুব ভারী?”
“খুব। সিঁড়ি দিয়ে ওটা নিয়ে উঠবার সময় আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছে।”
লোকটা আবার মাথা নাড়ল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
পল্টু কাঠুরিয়া কখনও দেখেনি ঠিকই, কিন্তু এই লোকটার হাবভাব পেঁয়ো বা অশিক্ষিত লোকের মতো যে নয়, তা সে স্পষ্টই বুঝতে পারছিল। তাই ফশ করে সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে?”
“আমি কাঠুরিয়া।”
“কিন্তু আপনাকে দেখে কাঠুরিয়া বলে মনে হয় না।”
লোকটা একটু হাসল। বলল, “যে কাঠ কাটে তাকে তো কাঠুরিয়াই বলে।”
পল্টুর সন্দেহ গেল না। তবে সে কথাও আর বাড়াল না।
লোকটা কী যেন ভাবছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ আপনমনে বলল, “ব্যাপারটা বড্ড জট পাকিয়ে গেছে।”
“কোন ব্যাপারটা?”
“তুমি যে ব্যাপারটার কথা বললে।”
“আমি কি বাড়ি ফিরে যেতে পারব আজ?”
লোকটা কী যেন ভাবছে। ভাবতে ভাবতেই বলে, “পারবে। এ জায়গাটা এমন কিছু দুর্গম নয়। প্রায়ই লোকজন যাতায়াত করে। কাঠুরিয়া আসে, মউলিরা আসে, জেলেরা আসে।”
“আপনি কি এখানেই থাকেন?”
“মাঝে-মাঝে থাকতে হয়।”
“ভয় করে না?”
“না। ভয় কিসের? জঙ্গলে যেমন বিপদ আছে, শহরেও তেমনি আছে। বরং বেশিই আছে।”
“আপনি কি শুধু কাঠই কাটেন? আর কিছু করেন না?”
“করি। আমাকে চারধারে নজর রাখতে হয়।”
“তার মানে?”
লোকটা কথাটার জবাব দিল না। আবার ভাবতে লাগল। মুখোনা খুব গম্ভীর।
দূরে একটা ঘুঘু পাখি ডাকছিল। লোকটা হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শুনে নিয়ে পল্টুর দিকে চেয়ে বলল, “আমি একটু আসছি। তুমি কোথাও যেও না।”
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“একটা ঘুঘু ডাকছে। ঘুঘুটা আমার পোষা। কেন ডাকছে। দেখে আসি।”
লোকটা বেরিয়ে গেল। নিঃশব্দে।
পল্টু এক সেকেন্ড অপেক্ষা করেই লাফ দিয়ে উঠে ছুটে গেল দরজায়। পাল্লাটা একটু ফাঁক করে দেখল, লোকটা ধ্বংসস্তৃপটা পার হয়ে লম্বা পায়ে হেঁটে যাচ্ছে।
পল্টু বুঝতে পারছিল না, লোকটা কে বা কেমন। তবে এ যে কাঠুরিয়া নয় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মুখোশধারী বলেছিল তাদের সর্দার এই দ্বীপে থাকে। এই লোকটা সত্যিই সেই সর্দার নয় তো! ব্যাপারটা জানা দরকার।
পল্টু গাছের আড়াল-আবডাল দিয়ে লোকটার পিছনে চলতে লাগল। কিন্তু লোকটা জঙ্গলে চলাফেরায় অভ্যস্ত। পল্টু নয়। উপরন্তু তাকে গা ঢাকা দিয়ে চলতে হচ্ছে। বারবার লোকটাকে হারিয়ে ফেলছিল পল্টু। তবে বেশিদূর যেতে হল না। মিনিট দুয়েক হাঁটার পরেই পল্টু দেখল সামনেই খাঁড়ি। দৈত্যের মতো লোকটা একটা গাছের ধারে থেমেছে। খাঁড়িতে একটা সবুজ রঙের ছোট্ট মোটরবোট থেকে একজন লোক ডাঙায় নেমে লোকটার দিকে উঠে আসছে।
লোকটার মুখ দেখে পল্টুর বুকের মধ্যে রেলগাড়ির পোল পার হওয়ার মতো গুম গুম শব্দ হতে লাগল। চোখের পলক পড়ল না। লোকটার মুখে সিংহের মুখোশ।