“বলেন কী?”
“প্রমাণ চান তো আমার সঙ্গে চলুন। আমার মুখোশটাকে ভয় পাবেন না। আমার মুখটা দেখতে ভাল নয় বলে মুখোশ পরি। এখন চলুন।”
মৃদঙ্গবাবু উত্তেজিত গলায় বললেন, “চলুন।”
“এই দিকে আসুন।” বলে নৃসিংহ অবতার মৃদঙ্গবাবুর হাত ধরে কোমরজল ভেঙে উত্তরদিকে এগোতে লাগল।
লোকটা ঘাঁতঘোঁত জানে। দিব্যি লোকজনের চোখের আড়াল দিয়ে, পুলিশের নাগাল এড়িয়ে জল ভেঙে একটা নিরিবিলি জায়গায় এনে ডাঙায় তুলল।
জায়গাটা মৃদঙ্গবাবু চেনেন। এক সময়ে এখানে নীলকুঠি ছিল। ভাঙা পোড়ো একখানা মস্ত বাড়ি আজও আছে। বিশাল বিশাল বটগাছ ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে চারধার। পারতপক্ষে লোকে এখানে আসে না। এখানে নাকি ভীষণ বিষাক্ত সাপের আড্ডা।
ডাঙায় তুলে লোকটা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলল, “এবার জিনিসটা দিয়ে দিন।”
মৃদঙ্গবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “মানে?”
“ন্যাকামি করবেন না মৃদঙ্গবাবু। গয়েশবাবুর বাড়িতে যে-জিনিসটা পেয়েছেন, সেটা দিয়ে দিন।”
“কিছু পাইনি তো?”
লোকটা হঠাৎ জামার ভেতর থেকে একটা পিস্তল বের করে বলল, “বেশি কথা বললে খুলি উড়ে যাবে।”
মৃদঙ্গবাবু জীবনে কখনও বন্দুক পিস্তলের মুখোমুখি হননি। আতঙ্কে ‘আঁ আঁ করে উঠলেন।
লোকটা বলল, “গয়েশবাবুর যে লেজ ছিল, সে-প্রমাণ আমার কাছে আছে। যদি সেটা চান তো জিনিসটা দিয়ে দিন।”
মৃদঙ্গবাবু হাঁ করে লোকটার দিকে চেয়ে ছিলেন। হাঁ-মুখের মধ্যে একটা মাছি ঢুকে মুখের ভিতরে দিব্যি একটু বেড়িয়ে আবার বার হয়ে এল।
“কই, দিন।” লোকটা তাড়া দেয়।
“কী রকম জিনিস?”
“একটা লকেট। তেমন দামি জিনিসেরও নয়। পেতলের।”
“মা কালীর দিব্যি, লকেটটা আমি পাইনি।”
“ন্যাকামি হচ্ছে?”
“না না। তবে আমার মনে হয়, লকেটটা সুমন্তবাবু পেয়েছেন।”
“ঠিক জানেন?”
“জানি। উনিও ওসময়ে ঘুরঘুর করছিলেন।”
“উনি কোথায়?”
“পালিয়েছেন। জলে নেমে সাঁতার দিয়ে পালিয়েছেন। পালানোর ভঙ্গি দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল, কিছু একটা হাতিয়ে এনেছেন গয়েশবাবুর বাড়ি থেকে।”
“আচ্ছা, সুমন্তবাবুর সঙ্গেও মোলাকাত হবে। এখন আপনি যেতে পারেন।”
“যাব?” ভয়ে ভয়ে সুমন্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“যান। কিন্তু পুলিশের কাছে কিছু বলবেন না।”
“না না। পুলিশের সঙ্গে আমার দেখাই হবে না। আমি এখন দিশেরগড়ে মাসির বাড়ি যাব। মাসখানেকের মধ্যে আর ফিরছি না।”
এই বলে মৃদঙ্গবাবু তাড়াতাড়ি রওনা হলেন। কিন্তু দশ পাও যেতে হল না তাঁকে। পিছন থেকে কী যেন একটা এসে লাগল মাথায়।
মৃদঙ্গবাবু উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন। নৃসিংহ অবতার এগিয়ে এল। মৃদঙ্গবাবুর মাথার কাছেই ঘাসের ওপর পড়ে থাকা বলটা কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে পুরল। তারপর দ্রুত হাতে মৃদঙ্গবাবুর শরীর তল্লাশ করতে লাগল।
যা খুঁজছিল, তা পেয়েও গেল লোকটা। তারপর হোগলার বনে নেমে জলের মধ্যে চোখের পলকে মিলিয়ে গেল।
৭. সুমন্তবাবু প্রথমটায় প্রাণপণে সাঁতরে
সুমন্তবাবু প্রথমটায় প্রাণপণে সাঁতরে ঝিলের অনেকটা ভিতর দিকে চলে গেলেন। পুলিশের ভয়ে সাঁতারটা একটু তেজের সঙ্গেই কেটেছেন। ফলে বেদম হয়ে হাঁফাতে লাগলেন।
সাঁতার জিনিসটা খারাপ নয়, তিনি জানেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাঁতার হল শ্রেষ্ঠ ব্যায়াম। কিন্তু ব্যায়ামেরও তো একটা শেষ আছে। আজ সকালেই সুমন্তবাবু অনেকটা দৌড়েছেন, ওঠবোস করেছেন, বৈঠকি মেরেছেন। তার ওপর এই সাঁতার
তাঁর শরীরের জোড়গুলোয় খিল ধরিয়ে দিল। জলও বেজায় ঠাণ্ডা।
ঝিলের মাঝমধ্যিখানে পৌঁছে সুমন্তবাবু একবার পিছু ফিরে দেখে নিলেন। না, নিশ্চিন্তি। অনেকটা দূরে চলে এসেছেন। এত দূর থেকে ঝিলের পারটা ধুধু দেখা যায়, কিন্তু তোকজন চেনা যায় না।
সুমন্তবাবু সাঁতার থামিয়ে চিত হয়ে ভেসে রইলেন কিছুক্ষণ। মৃদঙ্গবাবুর কী হল তা বুঝতে পারছেন না। লোকটা বায়োলজির পণ্ডিত সন্দেহ নেই, কিন্তু জীবনে বায়োলজিটাই তো সব নয়। সাঁতার জানলে আজ পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হত না।
চোখে প্রখর সূর্যের আলো এসে পড়ছে। সুমন্তবাবু চোখ বুজলেন। জলে চিত হয়ে ভেসে থাকাও যে খুব সহজ কাজ তা নয়। একটু-আধটু হাত-পা নাড়তে হয়। কিন্তু সুমন্তবাবুর হাত-পা ভীষণ ভারী হয়ে এসেছে।
একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন সুমন্তবাবু, ডাঙা অনেক দূর। ভয়ে সাঁতার দিয়ে এত দূর চলে এসেছেন বটে, কিন্তু ফের এতটা সাঁতরে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। যদিও ফিরে যেতে পারেন, তাহলেও লাভ নেই। পুলিশে ধরবে।
সুমন্তবাবু ধীরে-ধীরে ফের সাঁতরাতে লাগলেন। তিনি শুনেছেন, জলার মাঝে-মাঝে দ্বীপের মতো জায়গা আছে। তার কোনও একটাতে বসে যদি একটু জিরিয়ে নিতে পারেন তাহলে সন্ধের মুখে ধীরে-সুস্থে ফিরে যেতে পারবেন। কপাল ভাল থাকলে একটা জেলে-নৌকোও পেয়ে যেতে পারেন।
কিন্তু কিছুক্ষণ সাঁতার দেওয়ার পরই সুমন্তবাবুর দম আটকে আসতে লাগল। হাত-পা লোহার মতো ভারী। শরীরটা আর কিছুতেই ভাসিয়ে রাখতে পারছেন না। দুপুরে ভাল করে খাওয়াও হয়নি। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে।
সুমন্তবাবু গলা ছেড়ে হাক দিলেন, “বাঁচাও! বাঁচাও! আমি ডুবে যাচ্ছি!”
কিন্তু কেউ সে ডাক শুনতে পেল না।
এর চেয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেই বুঝি ভাল ছিল। সুমন্তবাবু মনে মনে মৃদঙ্গবাবুকে একটু হিংসেই করতে লাগলেন। সাঁতার না শিখেই তো লোকটা বেঁচে গেল।