সুমন্তবাবু তেরো পৃষ্ঠা পড়ে পাতা উল্টে চৌদ্দ পৃষ্ঠায় গেছেন মাত্র। সুবর্ণগড়ের রাজবাড়ির বিশ হাত উঁচু দেয়াল টপকে একজন লোক কাঠবেড়ালির মতো লাফ দিয়ে আমগাছের ডাল ধরে ঝুল খেয়ে মাটিতে নামল।
ঠিক এই সময়ে পিছন থেকে লোকটা লাফিয়ে পড়ল তাঁর ঘাড়ে।
ভাগ্যিস টোকলাটা মাথা থেকে খোলেননি। যেরকম জোরে তিনি চেয়ার থেকে মাটিতে ছিটকে পড়েছিলেন তাতে মাথা ফেটে যাওয়ার কথা। ফাটল না টোকলাটার জন্যই। বুকের ওপর একটা লোক চেপে বসে বলছে, “হুঁ হুঁ বাছাধন, এবার?”
সুমন্তবাবুর সারা গায়ে ব্যথা। অনভ্যাসের ব্যায়াম করলে যা হয়। তবু তিনি ঝটকা মেরে উঠতে গেলেন এবং দুজনে জড়াজড়ি করে মেঝেয় গড়াতে লাগলেন। সুমন্তবাবুর মনে হচ্ছিল, একটু ভুল হচ্ছে। ভীষণ ভুল।
আগন্তুক লোকটাও যেন তার ভুল বুঝতে পেরেছে।
হঠাৎ লোকটা বলে উঠল, “সুমন্তবাবু না?”
সুমন্তবাবুও বলে উঠলেন, “আরে! মৃদঙ্গবাবু যে!”
গা-হাত ঝেড়ে উঠে মৃদঙ্গবাবু বললেন, “আর বলেন কেন!
এসেছিলাম গয়েশবাবুর ছেলেবেলার কোনো ফোটোগ্রাফ পাওয়া যায় কি না তা খুঁজে দেখতে।”
“ফোটোগ্রাফ? তা দিয়ে কী হবে?”
“গবেষণায় লাগবে। গয়েশবাবুর লেজ সংক্রান্ত গুজবটা সত্যি কি না তা আজ অবধি ধরতে পারলাম না। অথচ বেশ জোরালো গুজব! যদি সত্যি হয় তবে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে একটা মস্ত ওলটপালট ঘটে যাবে। তাই দেখছিলাম যদি গয়েশবাবুর একেবারে ছেলেবেলার কোনো ছবি থাকে, আর তাতে যদি লেজের প্রমাণ পাওয়া যায়। লোকটাকে তো আর পাওয়া যাবে না।”
সুমন্তবাবু একটু উত্তেজিত গলায় বললেন, “শহরে এতবড় একটা বিপর্যয় চলছে, আর আপনি খুঁজছেন গয়েশবাবুর লেজ! জানেন পল্টুকে গুম করা হয়েছে?”
মৃদঙ্গবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “জানি। কিন্তু গয়েশবাবুর লেজটাও কিছু কম গুরুতর ব্যাপার নয়।”
সুমন্তবাবু খুব উত্তেজিত গলায় বললেন, “তাহলে আমার কাছে শুনুন। গয়েশবাবুর মোটেই লেজ ছিল না।”
মৃদঙ্গবাবুও উত্তেজিত গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আপনি তা জানলেন কী করে?”
দুজনের যখন বেশ তর্কাতর্কি লেগে পড়েছে, তখন হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা বাজ পড়ার মতো শব্দ হল। “কী হচ্ছে এখানে? অ্যাঁ! কী হচ্ছে?”
দুজনেই চেয়ে দেখেন, দরজায় বজ্রাঙ্গবাবু দাঁড়িয়ে। দুই চোখে ভয়াল দৃষ্টি, দাঁত কিড়মিড় করছেন। সুমন্তবাবু আর মৃদঙ্গবাবু সঙ্গে-সঙ্গে মিইয়ে গিয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলেন।
বজ্রাঙ্গ অত্যন্ত কটমট করে দুজনের দিকে চেয়ে বললেন, “অনধিকার প্রবেশের জন্য আপনাদের দুজনকেই অ্যারেস্ট করছি।” বলেই পিছু ফিরে হুংকার দিলেন, “এই, কে আছিস?”
সুমন্তবাবু চোখের পলকে দৌড় দিলেন। খোলা জানালা গলে একলাফে বাগানে নেমে ছুটে গিয়ে হোগলাবনে ঢুকে ঝিলের জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পড়ার পর খেয়াল হল, তিনি একা নন। মৃদঙ্গবাবুও জলে ঝাঁপ দিয়েছেন।
সুমন্তবাবুর পাশাপাশি কোমরজলে দাঁড়িয়ে মৃদঙ্গবাবু বললেন, “আমি সাঁতার জানি না।”
“আমি জানি।”
“তাতে আমার কী লাভ?”
“আপনার লাভের কথা তো বলিনি। বলেছি আমি সাঁতার জানি।”
“আমি ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস জানি।”
“তাতে আমার কী?”
“আপনার কথা তো বলিনি। বললাম, আমি জানি।”
“আমি কৃমাসন জানি।”
“আমি ইভোলিউশন থিওরি জানি।”
“আমি হাঁফানির ওষুধ জানি।”
“আমি ব্যাঙের মেটাবলিজম জানি।”
এ সময়ে অদূরে একটা বজ্র-হুংকার শোনা গেল, “পাকড়ো! জলদি পাকাড়কে লাও।”
সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন হেগলাবনের আড়ালে ঝিলের পার থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।
সুমন্তবাবু প্রমাদ গুনে তৎক্ষণাৎ গভীর জলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জোরে সাঁতার দিতে লাগলেন।
পিছন থেকে করুণ গলায় মৃদঙ্গবাবু বললেন, “সুমন্তবাবু, আমি রয়ে গেলাম যে।”
সুমন্তবাবু বললেন, “আপনি পুলিশকে ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস আর ব্যাঙের মেটাবলিজম বোঝাতে থাকুন।”
মৃদঙ্গবাবু করুণতর স্বরে বললেন, “আমাদের বংশে যে কেউ কখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি। আমি পড়লে বংশের কলঙ্ক হবে যে!”
“আমার বংশেও কেউ পড়েনি।”
“আপনি ভীষণ স্বার্থপর।”
“আপনিও খুব পরোপকারী নন।”
হোগলাবন চিরে সিপাইটা এগিয়ে আসছে। কিন্তু মৃদঙ্গবাবুর কিছুই করার নেই। তিনি লজ্জায় চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলেন। পুলিশের হাতে নিজের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটা তিনি স্বচক্ষে দেখতে পারবেন না।
টের পেলেন পুলিশটা এসে তাঁর হাত ধরল। মৃদঙ্গবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “চলো বাবা সেপাই, শ্রীঘরে ঘুরিয়ে আনবে চলো।”
মৃদুস্বরে কে যেন বলল, “চলুন।” গলাটা পুলিশের বলে মনে হল না। সাবধানে চোখটা একটু খুলে মৃদঙ্গবাবু দেখলেন। দেখেই কিন্তু ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। গোঁগোঁ করে একটা শব্দ বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। লোকটাই ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল।
ঠিক লোক নয়। নৃসিংহ অবতার। শরীরটা মানুষের মতো বটে, কিন্তু মুখটা সিংহের।
মৃদঙ্গবাবু চিচি করে বললেন, “আমি কিছু জানি না। আমাকে ছেড়ে দিন।”
নৃসিংহ অবতার গম্ভীর গলায় বলল, “বাঁচতে চাইলে আমার সঙ্গে চলুন। নইলে পুলিশের হাত এড়াতে পারবেন না। আপনার বংশের মুখে কালি পড়বে।”
কথাটা অতি সত্যি। মৃদঙ্গবাবু সভয়ে বললেন, “আপনি কে?”
“আমি যেই হই, সেটা বড় কথা নয়। তবে আপনাকে চুপিচুপি বলে রাখি গয়েশবাবুর কিন্তু সত্যিই লেজ ছিল।”