অজ্ঞান হয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
৬. দুপুরে খেতে বসে সুমন্তবাবু
দুপুরে খেতে বসে সুমন্তবাবু বললেন, “ব্যায়াম। ব্যায়াম। ব্যায়াম ছাড়া কোনও পন্থা নেই। ব্যায়াম না করে করেই বাঙালি শেষ হয়ে গেল। বিকেল থেকে পাঁচশো স্কিপিং শুরু করো সান্টু। মঙ্গল, তুমি ব্যায়ামবীর বটে, কিন্তু ফ্যাট নও। শরীরে কেবল মাংস জমালেই হবে না, বিদ্যুতের মতো গতিও চাই। গতিই আর একটা শক্তি। আজ বিকেল থেকে তুমি গতি বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করবে। কমলা, তুমি আর তোমার মাকে নিয়েই আমার প্রবলেম। তোমরা কপালগুণে মেয়েমানুষ। শাস্ত্রে মেয়েদের ব্যায়ামের কথা নেই। কিন্তু শহরে বিপদ দেখা দিয়েছে, সকলেরই খানিকটা শক্তিবৃদ্ধি দরকার। আমাদের পেঁকিটা আজকাল ব্যবহার হয় না। আমার মা ওই টেকিতে পাড় দিয়ে-দিয়ে বুড়ো বয়স পর্যন্ত শুধু বেঁচেই আছেন যে তাই নয়, খুবই সুস্থ আছেন। একবার আমাদের বাড়িতে দুদুটো চোরকে ধরে তিনি মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন। সুতরাং আজ থেকে তুমি আর তোমার মা কেঁকিতে পাড় দিতে শুরু করো। ওফ, কাঁকালে বড় ব্যথা।” বলে সুমন্তবাবু যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করলেন।
কুমুদিনী দেবী বললেন, “তা না হয় হল, কিন্তু ব্যায়াম করে গায়ে জোর হতে তো সময় লাগে। ততদিনে যদি ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায়? তার চেয়ে আমি বলি কী, একটা কুকুর পোযো।”
সুমন্তবাবু বললেন, “সেটা মন্দ বুদ্ধি নয়। বজ্রাঙ্গবাবুর সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, গয়েশবাবু খুনই হয়েছেন। লাশটা হয়তো জলায় ফেলে দিয়েছে। গয়েশবাবু খুন হলেন কেন তা পরে জানা যাবে। আমার ধারণা, গয়েশবাবুর লেজটাই তার মৃত্যুর কারণ। আমাদের লেজ নেই বটে, কিন্তু অন্যরকম ডিফেক্ট থাকতে পারে। সান্টুর নাকটা লম্বা, মঙ্গলের কপালের দুদিকটা বেশ উঁচু, অনেকটা শিং-এর মতো, আমার অবশ্য ওরকম কোনো ডিফেক্ট নেই, তাহলেও…”
“আছে।” গম্ভীরভাবে কমলা বলল।
“আছে?” বলে অবাক হয়ে সুমন্তবাবু মেয়ের দিকে তাকালেন।
“তোমার গায়ে মস্ত-মস্ত লোম। বনমানুষের মতো।”
সুমন্তবাবু তাড়াতাড়ি ভাত মাখতে-মাখতে বললেন, “যাক সে কথা। বজ্রাঙ্গবাবু বলেছেন ‘দি কিলার উইল স্ট্রাইক এগেন। আমাকে সতর্ক থাকা দরকার।”
ঠিক এই সময়ে বাইরে একটা হৈ চৈ শোনা গেল। কে যেন ঢোল বাজাচ্ছে আর চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে কী বলছে।
সান্টু লাফিয়ে উঠে বাইরে ছুটল। পিছনে সুমন্তবাবু, মঙ্গল, কমলা, কুমুদিনী।
দেখা গেল, নাপিত নেপাল সুমন্তবাবুর ফটকের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঢোল বাজাতে বাজাতে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে, “দুয়ো দুয়ো, হেরে গেল।”
সুমন্তবাবু হেঁকে বললেন, “কে হেরে গেল রে ন্যাপলা! বলি ব্যাপারখানা কী?”
নেপাল ঢোল থামিয়ে একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে এবার আর আমার সঙ্গে পারবেন না। একেবারে কাকের মুখ থেকে খবর নিয়ে এসেছি। সকালবেলা খুব জব্দ করেছিলেন আজ। গয়েশবাবুর খবরটা সবে গঙ্গাগোবিন্দবাবুকে দিতে যাচ্ছিলুম সেই সময় আপনি এমন হেঁড়ে গলায় পেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করলেন যে, আমি একেবারে চুপসে গেলুম। কিন্তু এবার আমি মার দিয়া কেল্লা।”
সুমন্তবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, “বলছিস কী রে ন্যাপলা? আবার কিছু ঘটেছে নাকি?”
নেপাল ঢেলে চাঁটি মেরে চাটিস-চাটিস বোল বাজিয়ে কিছুক্ষণ নেচে নিয়ে বলল, “ঘটেছে বই কী। এই একটু আগে পল্টুকে পরীরা ধরে নিয়ে গেছে।”
“পরীরা ধরে নিয়ে গেছে কী রে।”
“তবে আর বলছি কী, আমার পিসশ্বশুরের স্বচক্ষে দেখা। পল্টু দারোগাবাবুর সামনে সাক্ষী দিয়ে জলার ধারে গিয়েছিল। সেখানে ঠিক সাতটা মেয়ে-পরী এসে তাকে হেঁকে ধরে। আমার পিসশ্বশুর জলায় মাছ ধরতে গিয়েছিল। নিজের চোখে দেখেছে, সাতটা পরী পল্টুকে ধরে নিয়ে ভেসে চলে যাচ্ছে মেঘের দেশে।”
সুমন্তবাবু এঁটো হাত ঘাসে মুছে নিয়ে শশব্যস্তে বললেন, “তাহলে তো খবরটা সবাইকে দিতে হচ্ছে।”
একগাল হেসে নেপাল বলে, “আজ্ঞে সেকাজ আমি সেরেই এসেছি। কারও আর জানতে বাকি নেই।”
সুমন্তবাবু বাস্তবিকই একটু দমে গেলেন। এত বড় একটা খবর, সেটা তিনি কিনা পেলেন সবার শেষে! কিন্তু কী আর করেন। দাঁত কিড়মিড় করে শুধু বললেন,”আচ্ছা, দেখা যাবে।”
কী দেখা যাবে, কী ভাবে দেখা যাবে তা অবশ্য বোঝা গেল। না। তবে সুমন্তবাবু আর খেতে বসলেন না। গায়ে জামা চড়িয়ে, পায়ে একজোড়া গামবুট পরে এবং মাথায় চাষিদের একটা টোকলা চাপিয়ে হাতে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
সান্টু আর মঙ্গল আবার খেতে বসে গিয়েছিল। কুমুদিনী দেবী একটু নিচু গলায় তাদের বললেন, “ওরে, ওই দ্যাখ, বাড়ির কর্তার মতিচ্ছন্ন হয়েছে। এই দুপুরে বিকট এক সাজ করে কোথায় যেন। চললেন। তোরাও একটু সঙ্গে যা বাবারা। কোথায় কী ঘটিয়ে আসেন বলা যায় না।”
সান্টু আর মঙ্গল শেষ কয়েকটা গ্রাস গপাগপ গিলে উঠে পড়ল। সান্টু তার গুলতি আর মঙ্গল একটা মাছ মারার ট্যাটা হাতে নিয়ে সুমন্তবাবুর পিছনে দৌড়োতে থাকে।
জলার ধারে পৌঁছে খুবই বিরক্ত হলেন সুমন্তবাবু। এমনিতেই জলাটা নির্জন জায়গা, তার ওপর ভূতপ্রেত আছে বলে সহজে লোকে এদিকটা মাড়ায় না। কিন্তু আজ জলার ধারে রথযাত্রার মতো ভিড়। বোঝা গেল, নেপাল ভালমতোই খবরটা চাউর করেছে। জেলেদের যে কটা নৌকো ছিল, সব জলে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। বহু লোক হোগলাবনে কোমরসমান জলে নেমে গাছ উপড়ে ফেলছে।