ব্রহ্মদৈত্য চাপা গলায় বলে উঠল, “তুই!”
গলা দিয়ে স্বাভাবিক স্বর বেরোল না। ফের ছাগলের ডাক। সেই ছাগলের গলাতেই পাঁচু বলে উঠল, “আমি!”
“তোকেই তো খুঁজছি! সেই ঢ্যাঙা, সুটকো, হাড়গিলে, দাঁত উঁচু চেহারা!”
পাঁচু বুদ্ধিমান। টপ করে বুঝতে পারল, লম্বাচওড়া হলেও লোকটা ব্ৰহ্মদৈত্য নয়। মানুষই। বুঝবার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচুর গলার স্বর ফিরে এল। খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, “উনি আমার পিসেমশাই।”
“কে কার পিসেমশাই!”
“ওই যার কথা বললেন। ঢ্যাঙা, সুটকো, হাড়গিলে, দাঁত উঁচু। সবাই ভুল করে কিনা। আমার আপন পিসেমশাই তো, তাই আমার সঙ্গে চেহারার খুব মিল। অনেকে যমজ ভাই বলে ভুল করে।”
দৈত্যটা যেন ভাবিত হল, “পিসেমশাই! পিসেমশাই! কোথায় তোর পিসেমশাই?”
“আছে মশাই, আছে। কিন্তু এত রাতে তাকে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে?”
লোকটা ঝোঁপ পেরিয়ে এসে পাঁচুর কাঁধ খামচে ধরে বলল, “কোথায় আছে? কোথায়?”
থাবা খেয়ে পাঁচু চোখে সর্ষেফুল দেখতে লাগল। কিন্তু বুদ্ধিটা গুলিয়ে যেতে দিল না। গলাটি মোলায়েম করে বলল, “আজ্ঞে আর ঝাঁকাবেন না, হাড়ে-হাড়ে খটাখট শব্দ হচ্ছে। বলছি, একটু দম নিতে দিন।”
“তাকে কী করব জানিস? বস্তায় পুরে আছড়ে-আছড়ে ঘেঁচে ফেলব। তারপর গরম জলে সেদ্ধ করব। তারপর গরম তেলে ভাজব।”
“খুব ভাল হয় তা হলে। দেখবেন আবার কাঁচা তেলে ছাড়বেন না। তেলটা বেশ ফুটে উঠলে, তবেই ছাড়বেন। নিজের পিসেমশাই বলেই কবুল করতে লজ্জা হয় মশাই, কিন্তু উনি খুব যাচ্ছেতাই লোক। এই দেখুন না, অগ্রহায়ণ মাসের ঠাণ্ডায় আমি ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছি, ট্যাঁকে পয়সা নেই, পেটে ভাত নেই, আর উনি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছন।”
কাঁধে আর-একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দৈত্যটা বলল,”কোথায় সে?”
“ওই যে বাড়িটা দেখছেন, সামনের ডান দিকের ঘরখানা, ওইখানে। তবে সাড়াশব্দ করবেন না। পিসেমশাইয়ের বন্দুক আছে। দুম করে বন্দুক চালিয়ে দিলে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।”
“বন্দুক!” বলে লোকটা যেন ভাবিত হয়ে পড়ল। নিজের কপালে একটু টোকা মেরে মাথা নেড়ে বলল, “না, তার তো বন্দুক থাকার কথা নয়! তার বন্দুক ছিল না।”
“ছিল না বলে কি হতে নেই মশাই? দশ বছর আগে আমারও তো দাড়িগোঁফ ছিল না, তা বলে এখন কি হয়নি? চালের দর কি আগে পাঁচ টাকা কিলো ছিল? এখন কী করে পাঁচ টাকা হল বলুন! আগে তো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরত, তা বলে কি এখন ঘোরে? এখন পৃথিবীই তো দেখছি সূর্যের চারদিকে পাক মেরে-মেরে হয়রান হচ্ছে। এই নবীগঞ্জে আগে চোর-ডাকাত ছিল কখনও? তা বলে কি এখন চোর-ডাকাত হয়নি?”
লোকটা এসব কথা কানে তুলল না। কেমন যেন ভয়-খাওয়া গলায় বলল, “বন্দুক! বন্দুকটা কী জিনিস বলো তো! লম্বামত দেখতে, দুম করে শব্দ হয়?”
“শব্দ বলে শব্দ! সে সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। তার ওপর পিসেমশাইয়ের বন্দুককে বন্দুক না বলে কামান বলাই ভাল।
গেল বার পিসেমশাই এক ডাকাতকে গুলি করেছিলেন, ডাকাতের গায়ে গুলি লাগেনি বটে, কিন্তু শব্দেই সে মূর্ছা গেল। পরে পুলিশ এসে জল-টল দিয়ে তার মূছ ভাঙায়। আরও কী হল জানেন? সেই শব্দে মশা-মাছি কাক-চিল সেই যে নবীগঞ্জ ছেড়ে পালাল, আর ছ’ মাসের মধ্যে এদিকপানে আসেনি।”
দৈত্যটা যেন একটু চঞ্চল হল, চারদিক চেয়ে হঠাৎ পাঁচুকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “বন্দুক! বন্দুক খুব খারাপ জিনিস। শব্দ হয়।”
বলেই চোখের পলকে ঘুরে অন্ধকারে দুদ্দাড় করে পালাতে লাগল। লোকটার আক্কেল বলে কিছু নেই। মচাত করে একটা গাছের ডাল ভেঙে ফেলল, একটা টিনের ক্যানেস্তারা প্রচণ্ড শব্দে ছিটকে ফেলল, খটাস করে ফটক খুলল। আর সেই শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে রায়বাবু চেঁচাতে লাগলেন, “কে রে! কে ওখানে?”
নাঃ, আজও হল না। পাঁচু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ল। কিন্তু নবীগঞ্জে এই অসুরটা কোত্থেকে হাজির হল, মতলবটাই বা কী, সেটা জানতে হচ্ছে। রায়বাবু বাতি জ্বেলে লাঠি হাতে বেরিয়ে আসতে-আসতে হাঁকডাক করছেন। তাঁর কাজের লোক, জোয়ান ছেলেরা, সব ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে। পাঁচু ধীরেসুস্থে তার থলি গুছিয়ে নিয়ে গা-ঢাকা দিল।
দুঃখবাবুর আজকাল ঘুম খুব পাতলা হয়েছে। গাঁট্টার ভয়ে সবসময়েই একটা আতঙ্ক। তবে ভালর মধ্যে এই যে, আগে যেমন যখন-তখন গাঁট্টা, কাতুকুতু, সুড়সুড়ি হত, এখন তেমনটা হয় না। প্রথম গাঁট্টাটা আজকাল খুব ভোরের দিকে হয়। আর মজা এই, গাঁট্টা খেয়েই উঠে পড়লে এবং দৌড়তে শুরু করলে আর কোনও উৎপাত থাকে না। দুঃখবাবু দৌড়লে যে ভূতটার কী সুবিধে, তা অনেক মাথা ঘামিয়েও দুঃখবাবু বুঝতে পারছেন না।
আজ মাঝরাতে হঠাৎ দুঃখবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে যেন অন্ধকারেও একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেলেন। সেই চোরটাই আবার এসেছে নাকি? চোরকে দুঃখবাবুর কোনও ভয় নেই, কারণ চোর তাঁর নেবেটা কী? তিনি বরং আগন্তুকের সাড়া পেয়ে খুশিই হলেন। দুটো সুখ-দুঃখের কথা তো বলা যাবে।
“কে, চোরভায়া নাকি? আরে, এসো, এসো। বোসো দেখি জুত করে। শরীর-গতিক সব ভাল তো! বাড়ির খবরটবর সব ভাল? খোকাখুকিরা ভাল আছে তো! আর বউ? তিনি ভাল আছেন তো।”
চোরভায়া জবাব দিল না, তবে বিকট একটা শ্বাস ফেলল।
“তা বেশ হাঁফিয়ে পড়েছ দেখছি ভায়া! বোসো, বসে একটু জিরোও। তোমার মেহনত তো কম নয়। রাত জেগে খুবই পরিশ্রম করতে হয় তোমাকে। তা দুধ-টুধ খাও তো নিয়মিত? এত পরিশ্রম, একটু দুধ-ঘি না হলে শরীরে এত সইবে কেন? আমি বলি কি, একটু চ্যবনপ্রাশ খেয়ে দ্যাখো, ওতে বেশ বল হয়।”