ভজনলাল দম ফেলার সময় পেল। বড্ড ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। হাতজোড় করে বলল, “নামটা ইয়াদ না হলে কোই হরজা নেই হুজুর। লেকিন লোকটা দেখতে কেমুন আছে সিটা তো বোলেন।”
দৈত্যটা একটা বিশাল শ্বাস ছাড়ল। সেই শ্বাসের ধাক্কায় ভজন এক-পা পিছিয়ে গেল যেন। শ্বাস ছেড়ে দৈত্যটা বলল, “লোকটা রোগাপটকা, ফরসা, একটু ট্যারা, মাথায় বাবরি চুল। বুঝলি? কোথায় লোকটা?”
ভজনলাল মাথা নেড়ে বলে, “মিলে যাবে হুজুর। জরুর মিলে যাবে। কাল হবিবপুরে হাটবার আছে, বহুত আদমি আসবে। ওইরকম তিন-চারটা আদমি ধরে লিয়ে আসব।”
লোকটা বড় বড় চোখে ভজনলালকে প্রায় ভস্ম করে দিয়ে বলল, “ফরসা বললাম নাকি? না, লোকটা কালোই হবে। আর ট্যারা নয়। অনেকটা চিনেম্যানের মতো দেখতে। আর রোগাপটকাও নয়। বেশ লম্বাচওড়া চেহারা। বুঝতে পেরেছিস কার কথা বলছি?”
“জি হুজুর, মিলে যাবে।”
দৈত্যটা দাঁত কিড়মিড় করে বাজ-পড়া গলায় বলল, “লোকটাকে পেলে আমি কী করণ জানিস?”
ভজন ভয়ে-ভয়ে বলে, “পিটবেন হুজুর। লোকটা মালুম হচ্ছে, বৃহহাত বদমাশ আছে।”
লোকটা একটা হাত মুঠো পাকিয়ে বলল, “আগে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাব। তারপর ময়দার মতো ঠাসব, দলা পাকিয়ে ফেলব। তারপর সেই দলাটা দিয়ে ফুটবল খেলব। তারপর কিছুক্ষণ লোফালুফি করব, তারপর নদীতে ফেলে দেব। তারপর তুলে এনে মুগুর দিয়ে চ্যাপ্টা করব। তারপর…”
ভজনলাল মাথা নেড়ে বলে, “সমঝ গিয়া মালিক। আদমিটার নসিব খারাপ আছে। যো ইচ্ছা হয় করবেন হুজুর, আমি আঁখ মুদিয়ে থাকব। “
“মনে থাকে যেন, লোকটা বেঁটে, কালো, মাথায় টাক, দাঁতগুলো উঁচু, গাল তোবড়ানো…”
“জি হুজুর। এখানে সব কিসিম পাবেন। কাল হাটবারে পসন্দ করে লিবেন। আমি একটা-একটা করে আদমি ধরে এনে হুজুরের সামনে ফেলে দিব, হুজুর পসন্দ করে লিবেন।”
দৈত্যটা চোখ মিটমিট করে বলল, “পছন্দ! পছন্দ করার কথা উঠছে কেন রে? আমি তাকে মোটেই পছন্দ করি না।”
“জি হুজুর। আপনার বাত ঠিক আছে। আমি ভি তাকে পসন্দ করি না।”
“মনে থাকে যেন, লোকটা বেশ লম্বা, ফোলা, মাথায় টাক
কিংবা বাবরি চুল, চিনেম্যান বা কাফ্রির মতো দেখতে, নাকটা থ্যাবড়া হতে পারে আবার চোখাও হতে পারে।”
“জি হুজুর। খুব ইয়াদ থাকবে। আপনি এখন গিয়ে আরাম করুন।”
দৈত্যটা আর-একটা শ্বাস ফেলে গদাম-গদাম করে নাগরা জুতোর শব্দ তুলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। তারপর জোরকদমে হেঁটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
ভজনলাল জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, “রামজি কি কৃপামে আজ তো বাঁচ গয়া। জয় রামজি, সীতা মায়ি, বজরঙ্গবলি কি! কাল ক্যা হোগা রামজিকি মালুম।”
রাত এগারোটাতেই নবীগঞ্জ নিশুতি। ঘোর অন্ধকার রাত্রি, তাতে আবার কুয়াশা পড়েছে। পাঁচু বিষয়কর্মে বেরিয়েছে। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, গায়ে চুপচুপে করে তেল মাখা, হাতে একটা থলি। থলিতে সিঁদকাঠি আছে, কুকুরের জন্য বিস্কুট আর মাংসের হাড় আছে, নানারকম চাবি আছে, শিক বাঁকানো আর কাঁচ কাটার যন্ত্রপাতিও আছে।
রায়বাবুর বাড়িতে চুরি করা শক্ত কাজ। রায়বাবুর একটা বিশাল কুকুর আছে। পাঁচু বার তিনেক চেষ্টা করে পেরে ওঠেনি। আজ সে তৈরি হয়েই এসেছে। গতকাল রায়বাবু ধান বেচে বেশ কয়েক হাজার টাকা পেয়েছেন। শোওয়ার ঘরে লোহার আলমারিতে রাখা আছে। কাজটা শক্ত। কিন্তু শক্ত কাজেই তো আনন্দ।
রায়বাবুর বাড়িটা বাইরে থেকে খুব ভাল করে দেখে নিল পাঁচু, কেউ জেগে আছে কিনা। জানলায় কান পেতে শুনল, ভেতরে শাসের যে শব্দ হচ্ছে তা ঘুমন্ত মানুষের শ্বাসের শব্দ কিনা। এসবের জন্য সূক্ষ্ম কান চাই। শিখতে অনেক সময় আর মেহনত খরচ হয়েছে পাঁচুর। তবে না সে আজ পাশ করা চোর।
কুকুরটা সামনের বারান্দায় থাকে। সেদিকটায় যায়নি পাঁচু। কোনও শব্দও করেনি। তবু কুকুরটা বোধ হয় টের পেয়ে আচমকা ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। পাঁচুর কাজ বাড়ল। বিরক্ত হয়ে সে সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে বারান্দার গ্রিলের ভেতরে বিস্কুট আর হাড় দুটো ছুঁড়ে ফেলল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল। বিস্কুট আর হাড়ে ঘুমের ওষুধ দেওয়া আছে। পাঁচ-ছ ঘণ্টা টানা ঘুম হবে।
একটা ঝোঁপের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইল পাঁচু। কুকুরটা একটু দ্বিধায় পড়ল। তারপর জিনিসগুলো শুকল। তারপর হাড়খানা নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু করল। তারপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।
আর দেরি নয়। চটপট কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। পাঁচু উঠে দাঁড়াল। ঝোঁপের ওপাশ থেকে আরও একজন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ওঠাটা কিছু অদ্ভুত। উঠছে তো উঠছেই। যেন শেষ নেই। পাঁচুর মাথার ওপরেও বোধ হয় আরও হাত দেড়েক উঠে গিয়ে তবে লোকটার ওঠা শেষ হল। শুধু উঁচুই নয়, বহরের দিকটাও দেখার মতো। এত বড় বহরের মানুষ পাঁচু কখনও দেখেনি। সামনের বাড়িটা, এমনকী বাগানটা অবধি আড়াল হয়ে গেল।
অন্য কেউ হলে চেঁচামেচি করত, ভিরমি খেত বা দৌড়ে পালাত। দৌড়ে পালানোর অবস্থা অবশ্য পাঁচুর নেই। ভয়ে হাত-পা সব অসাড় হয়ে গেছে। তবে তার অনেক দেখা আছে, অভিজ্ঞতাও প্রচুর। রাতবিরেতে বেরোলে কতরকম ঘটনাই ঘটে। সাপ, ভূত, পাগলা কুকুর। তবে এটি ব্ৰহ্মদৈত্য কিনা তা ঠাহর হল না তার। তবে শুকনো গলাটা পরিষ্কার করতে গিয়ে তার গলা থেকে একটা ছাগলের ডাক বেরোল।