হাবু বিশ্বাস খানিকক্ষণ হাঁ করে থেকে বলল, “ভীমরুল! সে তো জলের তলাতেও হুল দেয়। বাপ রে!”
বলে হাবু বিশ্বাস হাঁচোড়-পাঁচোড় করে খালের ওধারে উঠে ছুটতে লাগল।
নিমাই আর নিতাই দুঃখবাবুকে ছুটে আসতে দেখে লাফিয়ে উঠল।
“দুঃখদাদা, হলটা কী? ও দুঃখদাদা…”
কিন্তু দুঃখবাবু থামলেন না, জবাবও দিলেন না। দৌড়তে লাগলেন। নিমাই তখন নিতাইকে বলল, “ছোটো তো, লোকটা দৌড়চ্ছে কেন জানতে হবে।”
দুজনেই দুঃখবাবুর পেছনে ধাওয়া করতে লাগল।
হরিহরের পাঠশালার কাছাকাছি নিমাই আর নিতাই প্রায় ধরে ফেলল দুঃখবাবুকে।
তিনজনকে ওরকম ছুটে যেতে দেখে পাঠশালার ছেলেরা চেঁচিয়ে উঠল, “সার, বাঘ বেরিয়েছে! বাঘ বেরিয়েছে!”
হরিহর পণ্ডিত সঙ্গে-সঙ্গে পাঠশালা ছুটি দিয়ে বললেন, “তোমরাও সব দৌড়ে বাড়ি চলে যাও।”
ছুটি পেয়ে ছেলেরা সব হুল্লোড় করে বেরিয়ে পড়ল। তারপর দৌড়তে লাগল দুঃখবাবুর পেছনে-পেছনে। সঙ্গে চিৎকার, “বাঘ! বাঘ।”
“কোথায় বাঘ? আঁ! কোথায় বাঘ!”
বলতে বলতে বন্দুক হাতে বাসব দত্ত খিড়কির দরজা দিয়ে পালিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ল। হরেন চৌধুরী সারেগামা থামিয়ে তানপুরাটা বাগিয়ে ধরে চেঁচাতে লাগল, “অ্যাই খবর্দার! অ্যাই খবর্দার” নয়ন বোস কপিকলের দড়ি বেয়ে কুয়োয় নেমে গেল। সোজা কথায় নবীগঞ্জে হুলুস্থুল কাণ্ড। দৌড়োদৌড়ি, চেঁচামেচি।
দুঃখবাবু আর পারছেন না। দৌড়ঝাঁপের অভ্যাস নেই। শরীরও মজবুত নয়। নবীগঞ্জের পুবধারে মাধব ঘোষালের বাড়ির ফটক খোলা পেয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন। মাধব ঘোষাল বারান্দায় বসে তামাক খেতে-খেতে একটা পুঁথি দেখছিলেন। সোজা গিয়ে তাঁর সামনে পড়লেন দুঃখবাবু, “ঘোষালমশাই, রক্ষে করুন।”
গাঁয়ের সবচেয়ে বিচক্ষণ লোক বলে সবাই ঘোষালমশাইকে জানে। মাথা ঠাণ্ডা, বুদ্ধিমান, পরোপকারী। মাধব ঘোষাল দুঃখবাবুর দিকে চেয়ে পুঁথিটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“শ্যামা পালোয়ানের নাতির ঘরের পুতির অবস্থা যে শোচনীয় দেখছি। ওরে কে আছিস, এক গেলাস জল নিয়ে আয়।”
দুঃখবাবু ঢকঢক করে জল খেলেন। মাধব ঘোষাল কান পেতে কী একটু শুনে বললেন, “গাঁয়ে এত গোল কিসের?”
দুঃখবাবু একটু দম নিয়ে বললেন, “আমাকে নিয়েই গণ্ডগোল। আমি দৌড়চ্ছিলাম দেখে কেউ ভাবল ভীমরুল, কেউ ভাবল বাঘ। সব খামোখা দৌড়োদৌড়ি-চেঁচামেচি করে মরছে।”
“তুমিই বা দৌড়লে কেন?”
দুঃখবাবু যেন বেজায় অবাক হয়ে বললেন, “দৌড়ব না? ভূতটা যে দিনরাত গাঁট্টা মারছে। দৌড়লে আর মারে না। থামলেই মারে। এই দেখুন, মাথার পেছনে সব সুপুরি তুলে দিয়েছে।”
মাধব ঘোষাল দেখলেন। বাস্তবিকই তিন-চার জায়গা রীতিমত ফুলে আছে। ঘোষাল একটু চিন্তিত মুখে বলেন, “গাঁট্টা মারছে কেন তা কি আন্দাজ করতে পেরেছ?”
“আজ্ঞে না। কখনও কাতুকুতু দেয়, কখনও সুড়সুড়ি, কখনও গাঁট্টা। প্রথমটায় সুড়সুড়ি আর কাতুকুতুই দিত। তারপর হঠাৎ গাঁট্টা শুরু হয়েছে।”
মাধব ঘোষাল একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “তার মানে সুড়সুড়ি আর কাতুকুতুতে কাজ হয়নি। তাই গাঁট্টা মারতে শুরু করেছে।”
দুঃখবাবু একটু অবাক হয়ে ঘোষালের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “কাজ হয়নি! কাজ হয়নি মানে কি ঘোষালমশাই!”
মাধব ঘোষাল ভ্রূকুটি করে দুঃখবাবুর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে উঠলেন, “কপালে তোমার এখনও বিস্তর গাঁট্টা আর দৌড়োদৌড়ি লেখা আছে।”
দুঃখবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “সে কী? মরে যাব যে মশাই!”
“মরতে এখনই তোমাকে দিচ্ছে কে?”
২. নবীগঞ্জ রেলস্টেশন
রেলস্টেশন নবীগঞ্জ থেকে মাইল-দেড়েক দূরে। ব্রাঞ্চ লাইনের ছোট্ট স্টেশন। সারাদিনে দুখানা আপ আর দুখানা ডাউন গাড়ি যায়।
রাত দশটার ডাউন ট্রেনটা পাস করানোর জন্য পয়েন্টসম্যান ভজনলাল স্টেশনে এসেছে। এ-সময়টায় স্টেশনমাস্টারমশাই থাকেন না। ভজনলাল ডাল রুটি পাকিয়ে রেখে সময়মতো চলে আসে। ট্রেন পাস করিয়ে দিয়ে খেয়ে ঘুম লাগায়। এই ট্রেনে যাত্রী থাকে না। কেউ নামেও না, ওঠেও না।
আজও ট্রেনটা পাস করাচ্ছিল ভজনলাল। কিন্তু ট্রেনটা এসে দাঁড়াতেই সামনের কামরার একটা দরজা পটাং করে খুলে গিয়ে একটা বিভীষিকা নেমে এল। পরনে জরির পোশাক ঝলমল করছে। এরকম লম্বাচওড়া লোক ভজনলাল জীবনে দেখেনি। দুখানা হাত যেন শালখুঁটি, কাঁধ দু’খানা গন্ধমাদন বইতে পারে, আর বুকখানা যা চওড়া ভজনলালের খাঁটিয়াখানা বোধ হয় তাতে এঁটে যায়। লোকটা কামরা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সামনে ভজনলালকে দেখেই হুহুঙ্কারে জিজ্ঞেস করল, “উও কাঁহা?”
ভজনলাল এমন ঘাবড়ে গেল যে, হাত থেকে লাল-নীল বাতিটা খসে পড়ে গেল প্ল্যাটফর্মে। সে দু হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “কৌন হুজুর?”
লোকটা ফের হুঙ্কার ছাড়ল, “কাঁহা হ্যায় উও? আঁ! কাঁহা ছিপা হুয়া হ্যায়?”
ভজনলাল কাঁপতে কাঁপতে বলে, “নেহি মালুম হুজুর!”
লোকটা দুখানা বিশাল থাবায় ভজনলালের কাঁধ ধরে একটা রামঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “নেহি মালুম! নেহি মালুম! ক্যা নেহি। মালুম রে? আভি উসকো লে আও। কাঁহা ছিপায়গা উও?”
ভজন ভয়ে আধমরা। বলল, “জি হুজুর। জরুর কুঁড় লায়েঙ্গে। লেকিন উনকো নাম তো বতাইয়ে।”
দৈত্যটা ভজনলালকে ছেড়ে দিয়ে কপালে হাত বোলাতে-বোলাতে এবার বাংলায় বলল, “তাই তো! নামটা কী যেন! অনেক দিনের কথা কিনা। নামটা তো মনে পড়ছে না।”