সুড়সুড়ি আর কাতুকুতুর সঙ্গে গাঁট্টাটাও সুতরাং যোগ হল। আগে রাতে হত, আজকাল দিনমানেও হচ্ছে। কখনও গাঁট্টা, কখনও সুড়সুড়ি, কখনও কাতুকুতু। কে যে এসব করছে, তা বুঝতে পারছেন না দুঃখবাবু। ভূতই হবে। তবে আজকাল আর তেমন একা লাগছে না নিজেকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে যদি হঠাৎ বলে বসেন, “হায় রে, আমার কি কেউ নেই!” সঙ্গে-সঙ্গে মাথায় খটাং করে গাঁট্টা খেতে হয়।
আর কেউ না থোক, মাঝে-মাঝে পুঁটে সর্দার এসে তাঁর খোঁজখবর নেয়।
আজও পুটে ন্যাড়া হওয়ার আনন্দে ডগমগ হয়ে দুঃখবাবুর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁক মারল, “কই হে মাস্টার। আছছ টাছছ কেমন?”
দুঃখবাবু বিমর্ষ মুখে বেরিয়ে এসে বললেন, “আছি কই দাদা! সেই কাতুকুতু সমানে চলছে। গাঁট্টাও খেতে হচ্ছে প্রায়ই।”
পুটে সর্দার চোখ ছোট করে বলল, “কতবড় মাছ বললে! দেড় মন? উরেব্বাস! তা হলে তো মস্ত মাছই ধরেছ! কোথা থেকে ধরলে, রাজবাড়ির পুকুর থেকে নাকি?”
দুঃখবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “মাছের বৃত্তান্তই নয়। বড় কঠিন সমস্যা চলছে দাদা। আমি বোধ হয় এবার মারা পড়ব।”
পুটে গম্ভীর হয়ে বলে, “না রে ভাই, সে যুগ কি আর আছে? আগে তো এক পয়সাতেই ন্যাড়া হওয়া যেত। আজকাল মজুরি ঠেলে উঠেছে এক টাকায়। তা হলধর পুরনো খদ্দের বলে কমই নেয়, মাত্র একটা আধুলি। তোমার কাছ থেকেও ওই পঞ্চাশ পয়সাই নেবে, আমি বলে দেব’খন।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখবাবু বললেন, “গাঁট্টার যা বহর দেখছি তাতে পয়সা দিয়ে আর ন্যাড়া হতে হবে না। গাঁট্টার চোটে চুল সব উঠে যাবে।”
বলেই একটু আঁতকে উঠলেন দুঃখবাবু। কারণ কথাটা মুখ থেকে বেরোতেই একটা রাম গাঁট্টা এসে পড়ল মাথায়।
দুঃখহরণকে পেছনে ফেলে পুঁটে সর্দার ফের হাঁটা ধরল।
হাসি-হাসি মুখে রায়বাবু প্রাতভ্রমণ সেরে ফিরছেন। আহ্লাদি চেহারা, ফরসা, নাদুস-নুদুস। মুখে সদাপ্রসন্ন ভাব। হাতে রুপোর হাতলওলা লাঠি। সঙ্গে বিশাল অ্যালসেশিয়ান কুকুর প্রহরী।
“পাতঃপেন্নাম হই রায়বাবু। সব খবর ভাল তো?”
“হ্যাঁ ঠা, সব খবর ভাল। তা তোমার খবর-টবর কী?”
“আজ্ঞে, তা যা বলেছেন। কুকুরের মতো ভাল জিনিস আর হয় না। কুকুরের কাছে মানুষের অনেক কিছু শেখার আছে।”
রায়বাবু বুদ্ধিমান লোক। আর কথা বাড়ালেন না। বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। অনেকটা হাঁটা হয়েছে আজ। বাড়ি ফিরেই এক গেলাস নিমপাতার রস খাবেন! বুকটা ঠাণ্ডা হবে।
একটু এগোতেই দেখলেন, দুঃখমাস্টার দৌড়ে আসছেন। “ও কী, ও মাস্টার? দৌড়োচ্ছ যে! বাড়িতে আগুন লাগেনি তো!”
“আজ্ঞে না মশাই। দিনরাত ভূতের গাঁট্টা খাচ্ছি। আর পারা যাচ্ছে না।”
“ভূতের গাঁট্টা? সে আবার কী জিনিস? ভূতের কিল শুনেছি। গাঁট্টা তো শুনিনি!”
“খেলে বুঝতেন। ওঃ, ওই আবার! নাঃ, পারা যাচ্ছে না। আসি রায়মশাই, থামলেই গাঁট্টা মারছে।”।
রায়বাবু একটু অবাক হলেও ব্যাপারটা তাঁর খারাপ লাগল না। দুঃখহরণ কুঁড়ে লোক, কোনওকালে শরীরের দিকে নজর দেয়নি। এই যে দৌড়ঝাঁপ করছে, এতে ওর উন্নতি হবে। কিন্তু ভূতের গাঁট্টাটা কী জিনিস, তা তিনি বুঝতে পারলেন না।
বাড়ি ফিরে রায়বাবু পরম তৃপ্তির সঙ্গে এক গেলাস নিমপাতার রস তারিয়ে-তারিয়ে খেলেন। ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রায়বাবু স্বাস্থ্য ছাড়া কিছু বোঝেন না। স্বাস্থ্যের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন লিভার ভাল রাখাকে। ফলে চিরতা, কালমেঘ, শিউলিপাতা ইত্যাদি যত তেতো জিনিস আছে সারাদিন তা খেয়ে যান। বাড়ির লোকজন, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, কাজের লোক, এমনকী কুকুর-বেড়ালকেও খাওয়াতে চেষ্টা করেন। ফলে আজকাল সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলে। তাঁর রস খাওয়ার সময় হলেই স্ত্রী পাশের বাড়িতে, ছেলেমেয়েরা খাটের তলায়, ঠাকুর, কাজের লোক বাড়ির পেছনকার জঙ্গলে, বেড়ালরা বেপাড়ায় পালিয়ে যায়। শুধু প্রহরী পালায় না। তবে রায়বাবু রস খাওয়াতে এলে সে এমনভাবে দাঁত বের করে গড়-ড় গড়-ড় করে যে, রায়বাবু বিশেষ সাহস করেন না। তিনি ছাড়া আর যে কেউ তেতো খেতে চায় না এতে তিনি খুবই দুঃখ বোধ করেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন, দুনিয়াটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে।
ওদিকে দুঃখবাবু দৌড়চ্ছেন। দৌড়লে গাঁট্টা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দৌড় বন্ধ করলেই খটাং করে মাথায় গাঁট্টা পড়ছে। সুতরাং তাঁকে দৌড়তেই হচ্ছে।
ব্যায়ামবীর ভল্লনাথ তার উঠোনে দাঁড়িয়ে মুগুর ভাঁজছিল। দুঃখবাবুকে সামনের রাস্তা দিয়ে পড়ি-কি-মরি করে দৌড়তে দেখে সে আঁতকে উঠে চেঁচিয়ে বলল, “দৌড়চ্ছেন কেন দুঃখবাবু? কদমতলার ভীমরুলের চাকে কেউ ঢিল দিয়েছে নাকি?”
দুঃখবাবুর জবাব দেওয়ার সময় নেই। তিনি দৌড়ে হাওয়া হয়ে গেলেন। ভল্লনাথ “ওরে বাবা রে” বলে মুগুর ফেলে দৌড়ে গিয়ে খালের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
খালের জলে হাবু বিশ্বাসের মাথাটা ভুস করে ভেসে উঠল। বিরক্তির গলায় বলল, “দিলে তো সব ভণ্ডুল করে! এতবড় মাগুর মাছটাকে সাপটে তুলেছিলাম প্রায়। আচ্ছা বেআক্কেলে তোক হে তুমি! শরীরটাই তাগড়াই, মাথায় গোবর।”
ভল্লনাথ দু ঢোক জল খেয়ে ফেলল তাড়াহুড়োয়। হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, “ভীমরুলের চাকটা ভেঙেছে। আসছে সব ভোঁ-ভোঁ করে তেড়ে। ডুব দাও! ডুব দাও।”